২৯শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৫ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সোমবার , সকাল ৭:১২

ঈমান-আকীদা – পর্ব-২

ঈমান-আকীদা – পর্ব-২

আল্লাহ তাআলা অপার ক্ষমতার অধিকারী। তিনি স্রষ্টা হিসেবে যেমনিভাবে তাঁর বান্দার জন্য ভালো ও কল্যাণকর দিক সৃষ্টি করেছেন, তেমনি অকল্যাণ ও আমল বিনষ্টকারী বিভিন্ন প্রকারের গোনাহ সৃষ্টি করেছেন। সেগুলোর সবচেয়ে ভয়াবহ ও ক্ষতিকর গোনাহ হলো, শিরক।

শিরক এর পরিচয়, ভয়াবহতা ও প্রকারভেদ

আরবী অভিধানে শিরক (شرك) অর্থ: অংশ নেওয়া, অংশগ্রহণ করা, অংশীদার হওয়া, শরীক হওয়া।

আর (أَشْرَكَ) অর্থ হল: অংশীদার সাব্যস্ত করা।

শিরক এর পরিভাষিক অর্থ :

আইম্মায়ে কেরাম বিভিন্ন শব্দে শিরক এর পরিচয় দিয়েছেন। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্যগুলো একটি অপরটির পরিপূরক।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, যে সকল বিষয়ের অধিকার বা উপযুক্ততা একমাত্র আল্লাহ তাআলাই রাখেন, এমন বিষয়ে কোন মাখলুককে তার সমকক্ষ সাব্যস্ত করা হল শিরক। –আল-ইস্তিকামাহ ১/৩৪৪

তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সীমাবদ্ধ বৈশিষ্টসমূহের কোনোটির ক্ষেত্রে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে তার সমপর্যায়ের সাব্যস্ত করে সে মুশরিক। –মাজমূউল ফাতাওয়া ১৩/১৯

আল্লামা ইসমাইল শহীদ রহ. বলেন, ব্যাপকভাবে মানুষের মাঝে শিরক প্রচলিত, তাওহীদ দুর্লভ। অধিকাংশ ইমানের দাবীদার লোকেরা তাওহীদ ও শিরক এর অর্থ বুঝে না। ফলে মুসলমান হিসেবে পরিচিত হলেও তারা শিরকে লিপ্ত। এজন্য ইমান ও শিরকের অর্থ বুঝা জরুরি।

সাধারণত মানুষ বিপদের সময় পীর, নবী, ইমাম, শহীদ, ফেরেশতা ও পীরদেরকে ডাকে এবং তাদের কাছে নিজেদের মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য আবেদন করে। তাদের নামে মান্নত করে। অসুস্থতা থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের সন্তানদেরকে তাদের দিকে সম্মন্ধ করে নাম রাখে। যেমন, কারো নাম রাখে আব্দুন নবী (নবীর গোলাম), কারো নাম আলী বখ্শ (আলীর দান), কারো নাম হুসাইন বখ্শ (হুসাইনের দান), কারো নাম পীর বখ্শ (পীরের দান), কারো নাম গোলাম মুহি উদ্দীন (মুহি উদ্দীনের গোলাম), কারো নাম (গোলাম মুঈন উদ্দীন (মুঈন উদ্দীনের গোলাম)। আবার কেউ কেউ কোন ব্যক্তির নামে মাথায় ঝুটি রাখে। কেউ কারো নামে কাপড় ইত্যাদি পরায়, কেউ কারো নামে বেড়ি পরায়, কেউ কারো নামে জন্তুর নাম রাখে, কেউ বা বিপদের সময় (আল্লাহ ছাড়া অন্য) কারো নাম নিয়ে ডাকে, অন্যের নামে কসম করে। মোট কথা, অমুসলিম মুশরিকরা যে কাজগুলো তাদের দেব-দেবীদের সাথে করে, সে কাজগুলো নামধারী মুসলমানরা নবী, ওলী, ইমাম, শহীদ, ফেরেশতা ও পীরদের সাথে করে থাকে। এতদসত্বেও তারা নিজেদেরকে প্রকৃত মুমিন বলে দাবী করে। আল্লাহ তাআলা সত্য বলেছেন, অধিকাংশ মানুষ ইমান আনার পরও শিরক করে।- সূরা ইউসুফ (১২) : ১০৬, তাকয়িয়াতুল ঈমান, পৃ. ২০

শিরকের ভয়াবহতা

কোরআন ও হাদীসে শিরক ও মুশরিকের ভয়াবহ পরিণামের কথা বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে কিছু উল্লেখ করা হলো-

 

. ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ :

মানুষ সগীরা-কাবীরা যত গুনাহ-ই করুক, আল্লাহ তাআলা চাইলে তা ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু শিরকের গুনাহ তিনি কিছুতেই ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন,

{إِنَّ اللهَ لاَ يَغْفِرُ أَنْ يُّشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيْمًا}

অর্থ: নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করবেন না। এ ব্যতীত অন্য সব, যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করল, বস্তুত সে আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করল। -সূরা নিসা (৪) : ৪৮

. জান্নাত হারাম জাহান্নাম অবধারিত করে দেয় :

যে ব্যক্তি শিরক করে তার জন্য জান্নাত হারাম এবং জাহান্নামে যাওয়া অবধারিত হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

{إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ أَنْصَارٍ}

অর্থ: নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন। তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম। আর অত্যাচারীদের কোন সাহায্যকারী নেই। -সূরা মায়িদাহ (৬) :৭২

. পূর্বের আমলসমূহ বিনষ্ট করে দেয় :

আল্লাহ তাআলা বান্দার সৎ কাজগুলোর সাওয়াব বৃদ্ধি করে দেন। কিন্তু শিরক বান্দার ভাল আমলগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। আল্লাহ বলেন,

{وَلَوْ أَشْرَكُوْا لَحَبِطَ عَنْهُم مَّا كَانُواْ يَعْمَلُوْنَ}.

অর্থ: যদি তারা শিরক করে তবে তাদের আমল সমূহ নষ্ট হয়ে যাবে।–আনআম (৫) :৮৮

তিনি আরো বলেন,

{وَلَقَدْ أُوْحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ}.

অর্থ: তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে যে, যদি তুমি আল্লাহর শরীক স্থির কর, তবে তোমার কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে। আর তুমি ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে।–যুমার (৩৯) :৬৫

. সবচেয়ে বড় গুনাহ :

কাবীরা গুনাহ, তথা বড় গুনাহ সমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় গুনাহ হল শিরক। একবার রাসূলুল্লাহ সা. সাহাবীগণকে লক্ষ্য করে বললেন,

>أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ؟ قُلْنَا: بَلى~ يَارَسُوْلَ اللهِ! قَالَ: اَلْإِشْرَاكُ بِاللهِ، وَعُقُوْقُ الْوَالِدَيْنِ<.

অর্থ: আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্পর্কে সংবাদ দিব না? আমরা বললাম, অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা এবং পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৭৬ , সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪৩

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

>اجْتَنِبُوْا السَّبْعَ المُوْبِقَاتِ<، قَالُوْا: يَا رَسُولَ اللَّهِ! وَمَا هُنَّ؟ قَالَ: >الشِّرْكُ بِاللَّهِ، وَالسِّحْرُ، وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالحَقِّ، وَأَكْلُ الرِّبَا، وَأَكْلُ مَالِ اليَتِيمِ، وَالتَّوَلِّي يَوْمَ الزَّحْفِ، وَقَذْفُ المُحْصَنَاتِ المُؤْمِنَاتِ الغَافِلاَتِ<.

অর্থ: তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক জিনিস থেকে বেঁচে থাকো। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ঐ ধ্বংসাত্মক জিনিসগুলো কি কি? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা, যাদু করা, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা যা আল্লাহ হারাম করে দিয়েছেন, সূদ খাওয়া, ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করা, যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা, সরলমনা, নির্দোষ, সতী-সাধ্বী মুমিনা নারীকে (যিনার) অপবাদ দেওয়া। –সহীহ বুখারী, হাদীস ২৭৬৬ , সহীহ মুসলিম,  হাদীস ১৪৫

আল্লাহ তাআলা বলেন,

{وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا}.

অর্থ: যে আল্লাহর সাথে শিরক করল সে জঘন্য পাপ করল।-সূরা নিসা (৪) :৪৮

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু তায়িালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

قُلْتُ يَارَسُوْلَ اللهِ أَىُّ الذَّنْبِ أَعْظَمُ عِنْدَ اللهِ؟ قَالَ: أَنْ تَجْعَلَ لِلّهِ نِدًّا وَهُوَ خَلَقَكَ<.

অর্থ, আমি রাসূলুল্লাহ সা.কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর নিকট জঘন্যতম পাপ কোনটি? জবাবে তিনি বললেন, কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বানানো (শরীক করা), অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৪৭৭, সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪১

শিরক এর প্রকার :

শিরক প্রথমত দুই প্রকার। যথা:-

(১) আল্লাহ তাআলার সত্তায় শরীক করা, যাকে Òশিরক ফিয যাতÓ বলা হয়।

(২) আল্লাহ তাআলার গুণাবলিতে শরীক করা, যাকে Òশিরক ফিস সিফাতÓ বলা হয়।

নিম্নে এগুলোর পরিচয় সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো:

. আল্লাহ তাআলার সত্তায় রী করা

মুসলমানদের বিশ্বাস হল, আল্লাহ্ তাআলা এক। তাঁর কোনো শরীক নেই। তাঁর কোনো পরিবার বা সন্তান নেই।

আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য ইলাহ, রব আছে বলে বিশ্বাস করা কিংবা তার সন্তান, স্ত্রী আছে বলে আকীদা পোষণ করা আল্লাহর সত্তার ক্ষেত্রে শিরক করার অন্তর্ভুক্ত।

. আল্লাহ তাআলার গুণাবলিতে শরিক করা

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

{وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا}.

অর্থ: আল্লাহ তাআলার জন্যই রয়েছে সুন্দর সুন্দর (গুণবাচক) নাম। সুতরাং তাকে সেসব নামেই ডাকবে। -সূরা আÔরাফ (৭) : ১৮০

হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, আল্লাহর তাআলার নিরানব্বইটি (গুণবাচক) নাম রয়েছে। যেমন-  রব (পালনকারী), ইলাহ (উপাস্য), খালিক (সৃষ্টিকর্তা) ইত্যাদি। এসব গুণাবলিতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে শরীক করা এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত।

আল্লাহ তাআলার এসব গুণাবলী দুই প্রকার। যথা:

প্রথম প্রকার: এমন গুণ যা মাখলুকের মাঝেও আছে। যেমন: দেখা, শোনা, শক্তি, ক্ষমতা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে মাখলুকের গুণাবলিকে আল্লাহর গুণাবলির সাথে তুলনা করা হলে, আল্লাহর গুণাবলীতে শিরক করার অন্তর্ভুক্ত হবে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

{ لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ}.

অর্থ: কোন কিছুই তার অনুরূপ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। -সূরা শূরা (৪২): ১১

ইমাম ত্বহাবী রহ. বলেন,

وَمَنْ وَصَفَ اللهَ بِمَعْنًى مِنْ مَعَانِيْ الْبَشَرِ فَقَدْ كَفَرَ، فَمَنْ أَبْصَرَ هَذَا اِعْتَبَرَ، وَعَنْ مِثْلِ قَوْلِ الْكُفَّارِ انْزَجَرَ، وَعَلِمَ أَنَّهُ بِصِفَاتِهِ لَيْسَ كَالْبَشَرَ.

অর্থ: আর যে ব্যাক্তি আল্লাহ তাআলাকে মানুষের গুণাবলী থেকে কোন গুণে গুণান্বিত করল সে কুফুরী করল। আর যে এই বিষয়টিকে গভীরভাবে বুঝবে, সে শিক্ষা গ্রহণ করবে এবং কাফেরদের অনুরূপ কথা বলা থেকে বিরত থাকবে। আর সে নিশ্চিত ভাবে জানতে পারবে যে, আল্লাহ তাআলার গুণাবলী মানুষের গুণাবলির ন্যায় না। -আকীদাতুত ত্বহাবী, পৃষ্ঠা: ২৫

দ্বিতীয় প্রকার: এমন গুণ যা আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত। যেমন:অদৃশ্য সম্পর্কে জানা, জীবন ও মৃত্যু দান করা, চিরঞ্জীব হওয়া ইত্যাদি। এ জাতীয় গুনাবলিতে অন্য কেউ গুণান্বীত হিসেবে বিশ্বাস করা, আল্লাহর গুণাবলিতে শিরক করার অন্তর্ভুক্ত হবে।

কুরআনুল কারীমে দ্বিতীয় প্রকারের বর্ণনা অনেকভাবে এসেছে। যেমন:

  • শিরক ফির রবুবিয়্যাহ্:

তাওহীদে রবুবিয়্যাহ হল দৃঢ়ভাবে এই বিশ্বাস স্থাপন করা যে আল্লাহ তাআলা সব কিছুর প্রতিপালক, তিনি সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, মালিক, ব্যবস্থাপক ও পরিচালক। তার ব্যবস্থাপনায় কোন অংশীদার নেই। তার কোন সাহায্যকারীর প্রয়োজন হয় না এবং তার প্রতিপালনাধীন কোন বিষয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই। আর আল্লাহ ছাড়া এসব কাজে অন্য কাউকে আংশিক বা পূর্ণমাত্রার অংশীদার সাব্যস্ত করা হলো শিরক ফির রবুবিয়্যাহ।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

{الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ}.

অর্থ: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলারই জন্য যিনি বিশ্বজগতের পালনকর্তা।

তিনি আরো ইরশাদ করেন,

{اللَّهُ الَّذِي خَلَقَكُمْ ثُمَّ رَزَقَكُمْ ثُمَّ يُمِيتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيكُمْ هَلْ مِنْ شُرَكَائِكُمْ مَنْ يَفْعَلُ مِنْ ذَلِكُمْ مِنْ شَيْءٍ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ}.

অর্থ: আল্লাহই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর রিযিক দিয়েছেন, এরপর মৃত্যু দেবেন, এরপর তোমাদের জীবিত করবেন। তোমাদের শরীকদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে এসব কাজের মধ্যে কোন একটি করতে পারে? তারা যাকে শরীক করে আল্লাহ তা থেকে পবিত্র ও মহান। -সূরা রুম (৩০) : ৪০

  • শিরক ফিল উলুহিয়্যাহ্/ ইবাদাহ :

ইবাদাতে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করার নাম হচ্ছে শিরক ফিল ইবাদাত। এটাকে শিরক ফিল উবূদিয়্যাহ বা শিরক ফিল উলুহিয়্যাহ” ও বলা হয়।

আল্লাহ তাআলা মানুষদেরকে কিছু কাজ শিখিয়ে দিয়েছেন, যাতে মানুষ তা দ্বারা আল্লাহ তাআলার সম্মান ও বড়ত্ব প্রকাশ করে। শরীয়তের পরিভাষায় এ কাজগুলোকে ইবাদাত বলে। এসকল কাজ আল্লাহ তাআলা ব্যতিত অন্য কারো সম্মানার্থে বা বড়ত্ব প্রকাশের উদ্দেশ্যে করাই হলো Òশিরক ফিল ইবাদাতÓ। যেমন: সিজদা করা, সর্বাবস্থায় বিশেষত বালা-মসিবতের সময় দোয়া করা, আশ্রয় প্রার্থনা করা, আল্লাহ তাআলার নিদর্শন সমূহের সম্মান করা, কুরবানী করা, মান্নত করা ইত্যাদি। সুতরাং এসকল আমলগুলো আল্লাহ তাআলা ব্যতিত অন্য কারো সম্মান, সন্তুষ্টি কিংবা নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে করা শিরক ফিল ইবাদাতের অন্তর্ভূক্ত হবে। -দেখুন, তাকয়িয়াতুল ইমান, পৃষ্ঠা:৫২

ইসলাম পূর্ব জাহেলী যুগে এ ধরণের শিরক বেশি প্রচলিত ছিল। এজন্য আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূলগণকে “তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ্” এর প্রতি দাওয়াত দেওয়া এবং Òশিরক ফিল উলুহিয়্যাহ্Ó থেকে নিষেধ করার জন্য বিশেষভাবে আদেশ দিয়েছেন।

আল্লাহ্ তাআলা এরশাদ করেছেন,

{وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ}.

অর্থাৎ, নিশ্চয়ই আমি প্রত্যেক জাতির নিকট কোনো না কোনো রাসূল পাঠিয়েছি এই নির্দেশনা দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর ও তাগুতকে বর্জন কর। –সূরা নাহল (১৬) : ৩৬

শিরক ফিল উলুহিয়্যাহ্ দুই প্রকার :

শিরকে আকবার বা বড় শিরক:

আল্লাহর সাথে কাউকে ইবাদাতের ক্ষেত্রে শরীক করা। এর মাধ্যমে মুমিন ঈমান থেকে বের হয়ে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হয়ে যায়। তাওবা ব্যতীত তার মুক্তির কোনো উপায় থাকে না। যেমন: মাজার-কবর ও মূর্তি ইত্যাদিকে সিজদা করা, তাদের নামে জবাই করা ও মান্নত করা, তাদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা ইত্যাদি।

শিরকে আসগার বা ছোট শিরক:

এটিকে  الشرك الخفي  বা গোপন শিরকও বলা হয়। এ ধরণের শিরকের দ্বারা তাওহীদে ত্রুটি সৃষ্টি হয় এবং কখনো কখনো তা বড় শিরক পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ- সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- সতর্ক করে বলেছেন,

 

>عَنْ مَحْمُودِ بْنِ لَبِيدٍ، أَنّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: >إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ الشِّرْكَ الأَصْغَرَ<، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَمَا الشِّرْكُ الأَصْغَرُ؟ قَالَ: >الرِّيَاءُ<، يَقُولُ اللَّهُ لَهُمْ يَوْمَ يُجَازِي الْعِبَادَ بِأَعْمَالِهِمُ: >اذْهَبُوا عَلَى الَّذِينَ كُنْتُم تُرَاءُونَ فِي الدُّنْيَا، فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً<.

হযরত মাহমূদ বিন লাবীদ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি তেমাদের জন্য ছেট শিরক এর ব্যাপারে বেশি আশংকা করি। সাহবায়ে কেরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! ছোট শিরক কী? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তা হল রিয়া (লোক দেখানেো আমল)। আল্লাহ তাআলা যেদিন তার বান্দাদেরকে প্রতিদান দিবেন সেদিন রিয়াকারীদের বলবেন, দুনিয়াতে যাদেরকে দেখানেোর উদ্দেশ্যে তেমরা ইবাদত করতে তাদের কাছে যাও এবং দেখ, তাদের কাছে কোন প্রতিদান পাও কি না?-মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ২৩৬৩০; শরহুস সুন্নাহ লিল বাগাভী, হাদীস ৪১৩৫ হাদীসটি সহীহ্।

কিছু ছোট শিরক হলো: রিয়া বা লোক দেখানো আমল, সুখ্যাতি অর্জনের জন্য আমল, দুনিয়া লাভ করার উদ্দেশ্যে আমল ইত্যাদি।

  • শিরক ফিল ইলম:

আল্লাহ তাআলা সকল জ্ঞানের আধার। তিনি দূরে-কাছে, দৃশ্য, অদৃশ্য, প্রকাশ্য-গোপন, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল বিষয়ে অবগত। কোন কিছুই তার থেকে গোপন নয়।

আল্লাহ্ তাআলা এরশাদ করেন,

{وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِنْ وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ }.

অর্থ: আর তারই কাছে আছে অদৃশ্যের কুঞ্জি। তিনি ছাড়া অন্য কেউ তা জানে না। স্থলে ও জলে যা-কিছু আছে, সে সম্পর্কে তিনি অবহিত। এমন কোনো পাতা ঝরে না, যে সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত নন। মাটির অন্ধকারে কোনো শস্যদানা অথবা আর্দ্র বা শুষ্ক এমন কোনো জিনিস নেই যা এক উন্মুক্ত কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই। -সূরা আনআম (৬) : ৫৯

তিনি আরো বলেন,

{قُلْ لَا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ}.

অর্থ: বলে দাও, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে আল্লাহ ছাড়া কেউ গায়েব জানে না এবং মানুষ জানে না তাদেরকে কখন পুনর্জীবিত করা হবে। -সূরা নামল (২৭) : ৬৫)

সুতরাং আল্লাহ তাআলা ছাড়া কোন ফেরেশতা, নবী, অলী, পীর-মাশায়েখ, জীন, পীর, জ্যোতিষী, জাদুকর, গনক, পণ্ডিত বা অন্য কারো ব্যাপারে এমন বিশ্বাস রাখা যে, তিনিও দূরে-কাছে, দৃশ্য, অদৃশ্য, প্রকাশ্য-গোপন, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত এর সবকিছু বা আংশীক জানেন, শিরক ফিল ইলম এর অন্তর্ভক্ত।

  • শিরক ফিত তাসাররুফ

শিরক ফিত তাসাররুফ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কোনো ফেরেশতা, নবী, অলী, পীর-মাশায়েখি, জিন-পরী, জ্যোতিষী, জাদুকর, গনক, পন্ডিত বা অন্য কোন মাখলুকের ব্যাপারে এই বিশ্বাস রাখা যে, তিনি অদৃশ্য থেকে কোনো মাধ্যম ব্যতিত (ما فوق الأسباب) কারও কোনো উপকার বা ক্ষতি করার শক্তি রাখেন। -জাওয়াহিরুল কুরআন, পৃষ্ঠা- ৪১

যেমন, বিপদের সময়ে কোন পীর, ওলী, জিন ইত্যাদিকে এ বিশ্বাসের সাথে ডাকা যে তিনি অদৃশ্য থেকেই আমার ডাক শুনছেন এবং অদৃশ্য থেকেই তিনি আমাকে সাহায্য বা উদ্ধার করতে পারবেন। কিংবা তাদের ভয়ে এজন্য ভীত থাকা যে, তারা অদৃশ্য থেকে কোন মাধ্যম ছাড়াই আমার কোনো ক্ষতি করে ফেলবেন।

অতএব, খালেছ তাওহীদে বিশ্বাস ও শিরক থেকে বেঁচে থাকা ব্যতীত জান্নাত হাসিল করা সম্ভব নয়। এজন্য আমাদেরকে আক্বীদার ক্ষেত্রে শিরকমুক্ত তাওহীদ এবং আমলের ক্ষেত্রে বিদআতমুক্ত সুন্নাতের অনুসারী হতে হবে।

একজন মুসলিম ব্যক্তি যখন শিরকে লিপ্ত হয় তখন তার ঈমান থাকেনা। তাই আমাদের সব সময় সচেতন থাকতে হবে যাতে আল্লাহর সাথে শরিক হয় এমন কোনো কথা বা কাজ আমরা থেকে প্রকাশ না পেয়ে যায়।

 

লেখক, মাওলানা হাবীবুল্লাহ

লেখক, গবেষক ও শিক্ষক

উস্তাদ, মারকাযুল উলূম আল-ইসলামিয়া হাজীপাড়া মাদরাসা, নারায়নগজঞ্জ, বাংলাদেশ।

#Leave A Comment

#Leave A Comment