২৯শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৫ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সোমবার , সকাল ৭:২০

পরিবারনীতি – পর্ব-১

পরিবারনীতি – পর্ব-১

বিবাহের শরয়ী বিধান, বিয়ে-পূর্ব প্রস্তুতি সংশ্লিষ্ট আলোচনা

 

বিবাহের শরয়ী বিধান

ব্যক্তির অবস্থা ভেদে বিবাহের বিধান ভিন্ন হয়ে থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় বিবাহ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। অর্থাৎ কেউ যখন স্ত্রীর মোহর ও খোরপোষ আদায়ের সামর্থ্য রাখ এবং শারিরীক সক্ষমতাও রাখ, পাশাপাশি ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা না করে, তখন তার জন্য বিবাহ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। কারণ, পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিবাহ আমাদের নবিজি মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ সমস্ত নবীদের সুন্নাহ। আর নবীর অনুসরণ করা সুন্নত। সে হিসেবে বিবাহ করাও সুন্নতে মুয়াক্কাদা।

আর যে ব্যক্তি বিবাহ না করলে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা বোধ করে অথবা নিজের চোখকে অবৈধ দৃষ্টিপাত থেকে, লজ্জাস্থানকে হস্তমৈথুন থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম না হয়, তাহলে তার জন্য বিবাহ করা ওয়াজিব। আর যে ব্যক্তি বিবাহ না করলে ব্যভিচার থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে না বলে নিশ্চিত হয়, তার জন্য বিবাহ করা ফরজ। তবে শর্ত হলো, স্ত্রীর খরচ চালানোর মতো আর্থিক সঙ্গতিও থাকতে হবে। যদি খরচ চালানোর মতো আপাতত আর্থিক সঙ্গতি না-ও থাকে, তবে তার জন্য ঋণ করে হলেও বিবাহ করা আবশ্যক। কারণ, আমরা পূর্বে  হাদীসের আলোকে উল্লেখ করেছি যে, নিজেকে পবিত্র রাখার উদ্দেশ্য বিবাহ করতে চাওয়া লোকের সহযোগিতা আল্লাহ তাআলা নিজে করার দায়িত্ব নিয়েছেন। এজন্য ঋণ করে হলেও তার উপর বিবাহ করা ফরজ।

আর যদি বিবাহ করলে তার কঠোর মেজাজের কারণে  স্ত্রীর উপর অবিচার করার আশঙ্কা করে, তবে তার জন্য বিবাহ করা মাকরূহ। কিন্তু অবিচারের ব্যাপারে নিশ্চিত হলে তার জন্য বিবাহ করা হারাম।-রদ্দুল মুহতার মাআদ দুররুল মুখতার ৮/১৮-২৪, তাহকীক, ফারফূর।

বিয়েপূর্ব প্রস্তুতি

যেকোনো কাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করার পূর্বে ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। প্রস্তুতি যদি যথাযথ হয়, তাহলে কাজটিও সুচারুরূপে সম্পন্ন হবে। অন্যান্য বিষয়ের মতো বিয়েও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিবাহিত জীবন সুখী-সমৃদ্ধ করতে হলে তার পূর্বপ্রস্তুতিও পুঙ্খানুপুঙ্খ হতে হবে। এজন্য বিয়ে-পূর্ব প্রস্তুতি সম্পর্কে সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ আলোচনা প্রয়োজন মনে করি।

বিয়ে-পূর্ব প্রস্তুতিকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করা যায়। যেমন-

১. ব্যক্তিগত প্রস্তুতি।

২. ছেলে-মেয়ে উভয়ের পারিবারিক প্রস্তুতি।

৩. সামাজিক প্রস্তুতি।

ব্যক্তিগত প্রস্তুতি

ব্যক্তিগত প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে কয়েকটি বিষয় আলোচনায় আসতে পারে। যেমন-

১. শারীরিক সক্ষমতা।

২. আর্থিক সঙ্গতি।

৩. মানসিক প্রস্তুতি।

১. শারীরিক সক্ষমতা

বিবাহের অন্যতম লক্ষ্য যেহেতু আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত জৈবিক চাহিদাকে বৈধভাবে পূরণ করা, সেজন্য শারীরিক সক্ষমতা থাকা বিবাহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তি নিজের ও তার স্ত্রীর চাহিদাকে পূরণ করার সামর্থ্য রাখে না। যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর চাহিদা পূরণের সক্ষমতা রাখে না, বিচারকের নির্দেশে স্ত্রী এমন ব্যক্তির সাথে বিবাহ ভঙ্গ করে দিতে পারে। বিচারক তাকে এক বছর পর্যন্ত অবকাশ দিবেন, যাতে সে তার অক্ষমতা দূর করতে পারে। এই এক বছরের ভেতরে সে ভালো কোনো চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হয়ে তার অক্ষমতা দূর করার চেষ্টা করবে। চিকিৎসার মাধ্যমে তার সক্ষমতা যদি ফিরে আসে তবে তার বিবাহ বহাল থাকবে, অন্যথায় এক বছরের মাথায় বিচারক তার বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে দিবেন। ইদ্দত পালনের পরে তার স্ত্রী অন্য কোনো পুরুষের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।-মুখতাছারুল কুদূরী, পৃ. ৫১২ (বুশরা)

বিয়ের উপযুক্ত সময় 

ইসলামে বিবাহের জন্য কোনো বয়স নির্ধারিত নেই। প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকে যেমন বিয়ে দেওয়া যায়, ঠিক তেমনই অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকেও বিবাহ দেওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

{وَاللَّائِي يَئِسْنَ مِنَ الْمَحِيضِ مِنْ نِسَائِكُمْ إِنِ ارْتَبْتُمْ فَعِدَّتُهُنَّ ثَلَاثَةُ أَشْهُرٍ وَاللَّائِي لَمْ يَحِضْنَ وَأُولَاتُ الْأَحْمَالِ أَجَلُهُنَّ أَنْ يَضَعْنَ حَمْلَهُنَّ وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مِنْ أَمْرِهِ يُسْرًا}

তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যাদের ঋতু আসার কোন আশা নেই, তোমাদের যদি (তাদের ইদ্দত সম্পর্কে) সন্দেহ হয়, তবে (জেনে রাখ) তাদের ইদ্দত হল তিন মাস। আর এখনও পর্যন্ত যারা ঋতুমতীই হয়নি, তাদেরও (ইদ্দত এটাই)। যারা গর্ভবতী, তাদের (ইদ্দতের) মেয়াদ হল তাদের সন্তান প্রসব। যে-কেউ আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার কাজ সহজে সমাধান করে দেন।-সূরা তালাক (৬৫) : ৪

আর এখনও পর্যন্ত যারা ঋতুমতীই হয়নি, তাদেরও (ইদ্দত এটাই) এই কথার মর্ম হলো, যদি কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেয়, তবে সেই মেয়ে তিন মাস পর্যন্ত ইদ্দত পালন করবে। স্বাভাবিক অবস্থায় একজন নারীর তালাকের ইদ্দত হচ্ছে তিন ঋতুস্রাব পর্যন্ত। অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কারণে যে নারীর এখনো ঋতুস্রাব শুরু হয়নি, তার ইদ্দত হলো আরবি মাস হিসেবে তিন মাস। এখানে ইদ্দত পালনের কথা থেকে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দেওয়া বৈধ। একই বিধান অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলের ক্ষেত্রেও। সন্তান বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে গেলে তাকে বিয়ে দেওয়া উচিত। এজন্য বলা যায়  বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পরের সময় বিয়ের উপযুক্ত সময়।

এ পর্যন্ত আলোচনা থেকে বোঝা গেল বিবাহের বয়স শরীয়া নির্দিষ্ট করে দেয়নি। প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের মতো অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকেও বিবাহ দেওয়া যায়। তবে অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের বিয়ের ব্যাপারে ইসলাম যেমন নিষেধাজ্ঞা দেয়নি, ঠিক তেমনই এর প্রতি উৎসাহিতও করেনি। তবে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পরে সন্তানের চরিত্র হেফাজতের স্বার্থে তাকে বিবাহ দেওয়ার প্রতি ইসলাম উৎসাহিত করেছে।

২. আর্থিক সঙ্গতি

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

>يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ، مَنِ اسْتَطَاعَ البَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ<

হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহের সামর্থ্য রাখে, এমন লোকেরা যেন বিবাহ করে। কারণ, বিবাহ চোখ এবং লজ্জাস্থানকে নিয়ন্ত্রণে বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আর যার সামর্থ্য নেই, সে যেন রোজা রাখে। কারণ, রোজা তার জৈবিক চাহিদাকে দমিয়ে রাখবে।-সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০৬৬

হাদীসের ব্যাখ্যা হলো, শারীরিক সক্ষমতার পাশাপাশি আর্থিক সামর্থ্য থাকলে বিবাহের সামর্থ্য অর্জিত হয়। কারণ, স্ত্রী-সন্তানের সার্বিক ব্যয়ভার বহন করা পুরুষের দায়িত্ব। আল্লাহ তাআলা বলেন,

{وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَنْ يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ لَا تُكَلَّفُ نَفْسٌ إِلَّا وُسْعَهَا لَا تُضَارَّ وَالِدَةٌ بِوَلَدِهَا وَلَا مَوْلُودٌ لَهُ بِوَلَدِهِ وَعَلَى الْوَارِثِ مِثْلُ ذَلِكَ فَإِنْ أَرَادَا فِصَالًا عَنْ تَرَاضٍ مِنْهُمَا وَتَشَاوُرٍ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا وَإِنْ أَرَدْتُمْ أَنْ تَسْتَرْضِعُوا أَوْلَادَكُمْ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِذَا سَلَّمْتُمْ مَا آتَيْتُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ}.

মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু বছর দুধ পান করাবে। (এ সময়কাল) তাদের জন্য, যারা দুধ পান করানোর মেয়াদ পূর্ণ করতে চায়। সন্তান যে পিতার, তার কর্তব্য ন্যায়সম্মতভাবে মায়েদের খোরপোষের ভার বহন করা। কাউকে তার সামর্থ্যরে বাইরে ক্লেশ দেওয়া হয় না। মাকে তার সন্তানের কারণে কষ্ট দেওয়া যাবে না এবং পিতাকেও তার সন্তানের কারণে নয়। অনুরূপ দায়িত্ব ওয়ারিশের উপরও রয়েছে। অতঃপর তারা (পিতা-মাতা) পারস্পরিক সম্মতি ও পরামর্শক্রমে (দুবছর পূর্ণ হওয়ার আগেই) যদি দুধ ছাড়াতে চায়, তবে তাতেও তাদের কোনো গুনাহ নেই। তোমরা যদি তোমাদের সন্তানদেরকে (কোন ধাত্রীর) দুধ পান করাতে চাও, তাতেও তোমাদের কোনো গুনাহ নেই যদি তোমরা ধার্যকৃত পারিশ্রমিক (ধাত্রীমাতাকে) ন্যায়ভাবে আদায় কর এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চলো এবং জেনে রেখ, আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ ভালোভাবে দেখছেন।-সূরা বাকারা (২) : ২৩৩

উপরিউক্ত কুরআনে কারীমের আয়াতের মাধ্যমে প্রমানিত হলো, পুরুষের উপর নিজের স্ত্রী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানাদির খোরপোষ প্রদান করা আবশ্যক। সেজন্য বিবাহের পূর্বে একজন পুরুষকে আর্থিক সঙ্গতি লাভ করতে হবে। এজন্য অর্থ উপার্জনের কোনো মাধ্যম অবলম্বন করতে হবে।

তিন: মানসিক প্রস্তুতি

যেকোনো কাজ সুন্দরভাবে সম্পাদন করতে হলে মানসিক প্রস্তুতি থাকা লাগে। মানসিক প্রস্তুতি ছাড়া হুট করে শুরু করলে কাজটি টেকসই ও মজবুত হয় না। অন্যান্য কাজের মতো বিবাহের পূর্বে মানসিক প্রস্তুতি থাকা জরুরি। দাম্পত্য জীবনের লম্বা এই জার্নিতে যত ঘাত-প্রতিঘাত আসবে, এসব সহজে মোকাবিলা করতে হলে মানসিক প্রস্তুতি লাগবেই।

মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আলাপ করতে গেলে যেসব বিষয় আলোচনায় আসতে পারে, তা হলো—

১. দোয়া

২. পড়াশোনা

৩. পাত্রী নির্বাচন

৪. পাত্র নির্বাচন

৫. পরামর্শ

৬. ইস্তিখারা

দুআ :       

দোয়া, একজন মুমিনের জীবনে অনন্য এক সম্পদ। কোরআন ও হাদীসে দোয়ার গুরুত্ব নিয়ে বেশ আলোচনা আছে। দাম্পত্য জীবনে মানসিক প্রস্তুতির শুরুটাও তাই দোয়ার মাধ্যমে হওয়া বাঞ্ছনীয়। কোরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেন,

{وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ}.

তোমাদের প্রতিপালক বলেছেন, আমাকে ডাক। আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। নিশ্চয়ই অহংকারবশে যারা আমার ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।-সূরা মুমিন (৪০) : ৬০

উপরিউক্ত আয়াতসহ অন্যান্য আয়াতের আলোকে বোঝা যায়, যারা আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করে, তারা তার প্রিয়। এবং দোয়া করা প্রশংসনীয়। দোয়া না করা অহঙ্কার। জানা কথা, অহঙ্কার ভালো কাজ নয়। পাশাপাশি দোয়ার ক্ষেত্রে কিছু নিয়মও বলে দেওয়া হয়েছে। একাগ্রচিত্তে দোয়া করা, অসম্ভব এবং অনর্থক জিনিস না চাওয়া, অবহেলা করে দোয়া না করা ইত্যাদি।

পড়াশোনা

যে বিষয় সম্পর্কে আপনার পড়াশোনা আছে, জানাশোনা আছে, সে কাজ আপনি সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে পারবেন, এটাই স্বাভাবিক। না পড়ে, না জেনে কোনো কাজ করতে যাওয়ার অর্থ, নিজেকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়া। অজ্ঞ লোকেরা না জানার কারণে জীবনের বহু ক্ষেত্রে নানান সমস্যার সম্মুখীন হয়, যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন জ্ঞানীরা হন না। এটা তো সর্বজনস্বীকৃত কথা, জ্ঞানী এবং মূর্খের মান সমান নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

{قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ}.

তবে কি (এরূপ ব্যক্তি সেই ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে,) যে রাতের মুহূর্তগুলোতে ইবাদত করে, কখনও সিজদাবস্থায়, কখনও দাঁড়িয়ে, যে আখেরাতকে ভয় করে এবং নিজ প্রতিপালকের রহমতের আশা করে? বল, যারা জানে আর যারা জানে না উভয়ে কি সমান?! (কিন্তু) উপদেশ গ্রহণ তো কেবল বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরাই করে।-সূরা যুমার (৩৯) : ৯

এজন্য বিবাহের মানসিক প্রস্তুতির দ্বিতীয় ধাপে বিবাহ সম্পর্কে পড়াশোনা থাকা চাই। বিবাহ সংশ্লিষ্ট মাসআলা-মাসায়িল ভালোভাবে রপ্ত থাকা চাই। দাম্পত্য জীবনে কি কি সঙ্কট আসতে পারে এবং এসবের সমাধান কী, আগে থেকে জানাশোনা থাকা চাই। বই নির্বাচনের ব্যাপারে নিজের কাছে নির্ভরযোগ্য জ্ঞানী মানুষের পরামর্শ নিতে পারেন এক্ষেত্রে। এভাবে অগ্রসর হলে ইনশাআল্লাহ আপনার দাম্পত্য জীবন হবে সুখের, আনন্দের। দুঃখের চ্যাপ্টারগুলো আপনার জীবনে তখন খুব কমই দেখা দেবে ইনশাআল্লাহ।

পাত্রী নির্বাচন

বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্রী নির্বাচনের ব্যাপারটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জীবনসঙ্গিনী যদি মনের মতো হয়, তবে দাম্পত্য জীবনের সকল চড়াই উৎরাই সহজেই পাড়ি দেওয়া যায়। এজন্য সঠিক পন্থায় পাত্রী নির্বাচন করতে হবে, যাতে করে ভুল মানুষের সাথে জড়িয়ে আপনার জীবন নরক না হয়ে ওঠে! একজন পুণ্যবতী যদি আপনার জীবনসঙ্গী হয়, তবে তার হাত ধরে খুব সহজেই পাড়ি দেওয়া যায় দুর্গম সব গিরিপথ!

একজন পুণ্যবতী খুঁজতে গেলে কী কী বিষয় লক্ষ্য রাখা চাই, এ সম্পর্কে এবার আলোচনা হতে পারে।

একজন পুণ্যবতীর খোঁজে

একজন পুণ্যবতী নারীর যেসব গুণাবলী থাকা প্রয়োজন—

১. মাহরাম-গায়রে মাহরাম পরিপূর্ণ ভাবে মেনে চলে। পর্দার ব্যাপারে কোন ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নেই। যে হবে নিজের আত্মমর্যাদার ব্যাপারে চূড়ান্ত সতর্ক।

জান্নাতি নারীদের তিনটি বিশেষ গুণ বর্ণনা করা হয়েছে কোরআনে। তারা হবে আনতনয়না অর্থাৎ পরপুরুষের দিকে তাকায় না। তাঁবুতে সুরক্ষিত অর্থাৎ ঘরে থাকা তাঁদের অভ্যাস, অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয় না। জান্নাতি পুরুষদের পূর্বে তাদেরকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি।-সূরা আর-রহমান (৫৫) : ৫৫, ৭২

২. বাকসংযমী হতে হবে কারণ চিন্তা ভাবনা করে যার কথা বলার অভ্যেস আছে, সে খুব কম বিপদে পড়ে। আর মেয়েদের জবান খুব রিস্কি। পরিবারে সাধারণত ঝগড়া বাধে মেয়েদের কারণে। সে জন্য কথাবার্তার ব্যাপারে যে মেয়ে আত্মসংযমী হবে, তাকে নিয়ে জীবন কাটানো অনেক স্বস্তির, শান্তিময়।

৩. স্বামীঅন্তপ্রাণা হতে হবে এর জন্য সবচেয়ে বড় প্রমাণ তার মায়ের চরিত্র। বাবার সাথে মায়ের ব্যবহার যদি ভাল হয়, তার মা যদি তার বাবার সাথে সম্মানজনক আচরণ করে, তাহলে আশা করা যায় ইনশাআল্লাহ মেয়েও সেরকম হবে। কারণ মেয়েরা সাধারণত মায়ের চরিত্র পায়। এটাও জান্নাতি নারীদের বড় একটি গুণ।-সূরা ওয়াকিয়াহ (৫৬) : ৩৭

৪. বয়সের পার্থক্য খুব বেশি না হওয়া চাই। বয়সের দূরত্ব বেশি হলে চিন্তার দূরত্ব থেকে যায়। কাছাকাছি বয়সের হলে বোঝাপড়া ভালো হয়। এজন্যই জান্নাতের রমণীগণের বয়স জান্নাতি পুরুষদের কাছাকাছি হবে।

৬. সব ক্ষেত্রে শরীয়াকে ঊর্ধ্বে রাখতে হবে শরীয়ার প্রতিটি নির্দেশনার প্রতি ভালোবাসা আর সম্মান থাকতে হবে। দ্বীনের বুঝ থাকতে হবে।

পাত্রী দেখতে গেলে যেসব বিষয় লক্ষণীয়

১. বিয়ের উদ্দেশ্যে কেবল পাত্রই পাত্রীকে দেখতে পাবে। অন্য কোনো পুরুষ পাত্রীকে দেখতে পারবে না, এমনকি পাত্রের বাবাও দেখতে পারবে না।

২. পাত্রীর কেবল মুখমণ্ডল, কব্জি পর্যন্ত হাত, টাখনু পর্যন্ত পা দেখা যাবে। এই অঙ্গগুলোর দিকে বারবার তাকানো যাবে। শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ উন্মুক্ত অবস্থায় দেখা যাবে না। তবে কাপড়ের উপর দিয়ে পুরো শরীর পরখ করা যাবে।

৩. পাত্র-পাত্রী পরষ্পর কথা বলতে পারবে। পারষ্পরিক কিছু জিজ্ঞাসা থাকলেও সেটাও সেরে নেওয়া যায় কথা বলার ফাঁকে। তবে কোনো অঙ্গ স্পর্শ করা যাবে না।

৪. পাত্রীর কোনো মাহরাম পুরুষ উপস্থিত থাকতে হবে। শুধুমাত্র পাত্র-পাত্রী একাকী অবস্থান করতে পারবে না।

৫. পাত্র-পাত্রী উভয়েই স্বাভাবিক সাজসজ্জা করতে পারে। তবে এমন সাজসজ্জা করতে পারবে না, যাতে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা আছে! যেমন, এতো বেশি পাউডার ব্যবহার করা যাতে কালো চেহারাকেও সাদা দেখা যায়!

৬. পাত্রী দেখে কোন হাদিয়া দেওয়া যেতে পারে। তবে তা আবশ্যক নয়।-বিয়ে ও তালাকের শরয়ী রূপরেখা, পৃষ্ঠা ৫৯-৬০, মূল জাস্টিস আল্লামা তাকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহ, অনুবাদ মুফতি শাব্বীর আহমদ

যা হোক, শরয়ী এসব নীতিমালা মেনে কুরবানির ঈদের পরে সায়েম গিয়ে দেখে আসে ফারহানের বোনকে। পবিত্র ঘরের পবিত্র মেয়ে, এমন মেয়ে কী পছন্দ না হওয়ার কথা?! তবুও সে সুন্নাহ হিসেবে ইস্তিখারা করে। ইস্তিখারা করার পরে বিয়ের প্রতি মনের ঝোঁক বুঝতে পারে। ফলে সে বিয়ের পক্ষে মত দিয়ে দেয়।

এবার বিয়ের দিন নির্ধারণের পালা। দুই পরিবারের পরামর্শে বিয়ের তারিখ ৫ই আগস্ট নির্ধারণ করা হয়। নির্ধারিত দিনে ফারহানের বোনের সাথে সায়েমের বিয়ে হয়ে যায়। সায়েমের একাকী জীবনের সমাপ্তি টেনে যুগল জীবনের সূচনা হয়।

সায়েমের ঘরে আর একাকিত্বের আঁধার নেই। তার ঘরে এখন পূর্ণিমার ঝলকানি। ফরিদা, মানে অনন্যা। সায়েমের জীবনসঙ্গিনী। তার পরম আরাধ্য পুণ্যবতী। জান্নাতে যাওয়ার পথে তার অন্যতম সহযোগী। এবার শুরু হলো জীবনের প্রত্যাশিত যাত্রা। একজন আরেকজনের হাত ধরে এগিয়ে চলা রবের সন্তুষ্টি পানে।

পাত্র নির্বাচন

পাত্রী নির্বাচন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনই পাত্র নির্বাচনও গুরুত্বপূর্ণ। বরং পাত্রী নির্বাচনের চেয়ে পাত্র নির্বাচনে আরো সতর্ক থাকা দরকার। কারণ, মৌলিকভাবে মেয়েদের তালাকের অধিকার নেই। বরং তালাক দেওয়া ছেলেদের অধিকার। যার কারণে ভুল জায়গায় সম্পর্ক স্থাপিত হলে ছেলের চেয়ে মেয়ের ক্ষতির আশঙ্কা বেশি।

যা হোক, পাত্র নির্বাচনে যে-সব বিষয় লক্ষণীয়, তা হলো—

১. দ্বীনদার হওয়া।

২. চরিত্রবান হওয়া।

৩. কুফু মিল থাকা।

৪. স্ত্রীর প্রতি আন্তরিকতার গুণ থাকা।

১-২. দ্বীনদার এবং চরিত্রবান হওয়া

নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

>إِذَا جَاءَكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِينَهُ وَخُلُقَهُ فَأَنْكِحُوهُ، إِلَّا تَفْعَلُوا تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الأَرْضِ وَفَسَادٌ<، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَإِنْ كَانَ فِيهِ؟ قَالَ: >إِذَا جَاءَكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِينَهُ وَخُلُقَهُ فَأَنْكِحُوهُ<.

যখন তোমাদের কাছে এমন কারো প্রস্তাব আসে যার দ্বীন ও চরিত্র তোমাদের পছন্দ হয়, তাহলে তার সাথে তোমাদের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিবে। তা যদি না কর, তবে পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি হবে। সাহাবীরা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! যদি তার মাঝে (কুফূ-এর দিক থেকে) কিছু ক্রটি থাকে? তিনি বললেন, যখন তোমাদের কাছে এমন কারো প্রস্তাব আসে যার দ্বীন ও চরিত্র তোমাদের পছন্দ হয় তাকে বিয়ে দিয়ে দিবে। এই কথা তিনি তিনবার বললেন।-জামে তিরমিজী, হাদীস ১০৮৫; ইমাম তিরমিজী রহ. বলেন, হাদীসটি হাসান গরীব।

এই হাদীসের আলোকে বোঝা গেল, দ্বীনদার এবং চরিত্রবান ছেলে পাওয়া গেলে বিবাহে বিলম্ব করা ঠিক না। অন্যথায় অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়বে। জমিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।

৩. কুফু মিল থাকা।

অনারবদের মাঝে কুফু বলতে বোঝায় ধর্মীয়,  পেশাগত এবং আর্থিক দিক দিয়ে উভয় পরিবার কাছাকাছি থাকা। এসব বিষয় খেয়াল করে বিবাহ দিলে সাংসারিক জটিলতার সম্ভাবনা কম থাকে। অন্যথায় ধর্মীয়, পেশাগত এবং আর্থিক দিক থেকে অমিল থাকলে সাংসারিক জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকবে। পরিবারে অশান্তির কালো ছায়া বিস্তার করতে পারে। তাই কুফুর ব্যাপারে খেয়াল রাখা উচিত।

৪. স্ত্রীর প্রতি আন্তরিকতার গুণ থাকা

ফাতিমা বিনতে কায়স নামে একজন সাহাবিয়া ছিলেন। তাকে আবু জাহম নামক একজন সাহাবী বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রস্তাব গ্রহণ না করার পরামর্শ দিলেন। কারণ, আবু জাহম খুব কঠোর প্রকৃতির মানুষ। তিনি পরিবারে সবসময়ই লাঠি ব্যবহার করেন। তার এই কঠোর স্বভাবের কারণে নবিজি বুঝতে পারলেন, তিনি তার স্ত্রীর সাথে আন্তরিক ব্যবহার করবেন না। এজন্য নবিজি এই প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ার পরামর্শ দিলেন।-সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৫৬৩

তাছাড়া আমরা পূর্বেও বলে এসেছি, নিজের কঠোর স্বভাবের কারণে স্ত্রীর উপর জুলুম হওয়ার আশঙ্কা করলে বিবাহ করা মাকরূহ। কারণ, বিবাহ মাটি দিয়ে তৈরি কোনো খেলাঘর নয়, যা খেলা শেষ হয়ে গেলে ভেঙে দেওয়া যায়। বিবাহ সুদীর্ঘ এক সফরের নাম, যে সম্পর্কের মূল গন্তব্য জান্নাত, জান্নাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত জীবনের সব ঝড়ঝাপটায় প্রিয় মানুষটিকে আগলে রাখার জন্যই দাম্পত্য সম্পর্কের সূচনা। এজন্য ভারসাম্যপূর্ণ মানসিকতার  অধিকারী ব্যক্তিকেই নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করা উচিত।

পরামর্শ 

পরামর্শ আল্লাহ তাআলার নির্দেশ, নবিজির সুন্নাহ। যেকোনো বৈধ কাজে বিজ্ঞ লোকদের সাথে পরামর্শ করে কাজ করলে কাজে বারাকাহ আসে। অনিষ্টতা থাকলে তা দূর হয়। অভিজ্ঞ মানুষদের কাজ থেকে পরামর্শ নিয়ে চললে জীবনের চলার পথ সহজ হয়। অনেক সময় বিজ্ঞ মানুষের সাথে পরামর্শ করে এমন কিছু জানা যায়, যা কিতাবের পাতা উল্টে পাওয়া যায় না! তাই বিবাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংসার জীবন সম্পর্কে বিজ্ঞ আল্লাহওয়ালা আলিমের সাথে পরামর্শ করা উচিত। এতে দাম্পত্য জীবনে হুঁচট খাওয়ার আশঙ্কা কমবে, সফল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। আল্লাহ তাআলা নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কুরআনুল কারীমে পরামর্শের নির্দেশ দিয়েছে।-সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৫৯

ইস্তিখারা

ইস্তিখারা আরবি শব্দ, যার অর্থ হলো কল্যাণ প্রার্থনা করা। কোনো বৈধ কাজ করার পূর্বে আল্লাহ তাআলার কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করা নবিজির সুন্নাহ। কাজটি আপনার জন্য কল্যাণকর নাকি অকল্যাণকর, তা আপনি জানেন না। আপনি আল্লাহ তাআলার কাছে এই মর্মে প্রার্থনা করবেন যে, হে আল্লাহ! এই কাজে যদি আমার জন্য কল্যাণ থাকে, তাহলে আপনি আমার জন্য তা সহজ করে দিন। এতে বারাকাহ দান করুন। আর যদি অকল্যাণ থাকে, তবে আমার মনকে তার থেকে ফিরিয়ে দিন। আমাকে রক্ষা করুন। হাদীসে আছে, জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের সব কাজে ইস্তিখারা শিক্ষা দিতেন, যেমন পবিত্র কুরআনের সূরা আমাদের শিখাতেন। তিনি বলেছেন: তোমাদের কেউ কোন কাজের ইচ্ছা করলে সে যেন দুরাকআত (নফল) নামায আদায় করার পর এ দুআ পড়ে-

>اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَسْتَخِيْرُكَ بِعِلْمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ، وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ العَظِيْمِ، فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلاَ أَقْدِرُ، وَتَعْلَمُ وَلاَ أَعْلَمُ، وَأَنْتَ عَلَّامُ الغُيُوْبِ، اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ خَيْرٌ لِيْ فِيْ دِينِيْ وَمَعَاشِيْ وَعَاقِبَةِ أَمْرِيْ، فَاقْدُرْهُ لِيْ وَيَسِّرْهُ لِيْ، ثُمَّ بَارِكْ لِيْ فِيْهِ، وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ شَرٌّ لِيْ فِيْ دِينِيْ وَمَعَاشِيْ وَعَاقِبَةِ أَمْرِيْ، فَاصْرِفْهُ عَنِّيْ وَاصْرِفْنِيْ عَنْهُ، وَاقْدُرْ لِيَ الخَيْرَ حَيْثُ كَانَ، ثُمَّ أَرْضِنِيْ<.

ইয়া আল্লাহ্! আমি আপনার ইলমের উসীলায় আপনার কাছে (উদ্দীষ্ট বিষয়ের) কল্যাণ চাই এবং আপনার কুদরতের ওসীলায় আপনার কাছে শক্তি চাই। আর আপনার কাছে চাই আপনার মহান অনুগ্রহ। কেননা, আপনিই (সব কিছুতে) ক্ষমতা রাখেন, আমি কোন ক্ষমতা রাখি না; আপনিই (সব বিষয়ে) অবগত আর আমি অবগত নই। আপনিই গায়েব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত। ইয়া আল্লাহ্! আমার দ্বীন, আমার জীবন-জীবিকা ও আমার কাজের পরিণাম বিচারে (অথবা বলেছেন) আমার কাজের আশু ও শেষ পরিণতি হিসাবে যদি এ কাজটি আমার জন্য কল্যাণকর বলে জানেন, তা হলে আমার জন্য তার ব্যবস্থা করে দিন। আর তা আমার জন্য সহজ করে দিন। তারপর আমার জন্য তাতে বরকত দান করুন।

আর যদি এ কাজটি আমার দ্বীন, আমার জীবন-জীবিকা ও আমার কাজের পরিণাম (অথবা বলেছেন) আমার কাজের আশু ও শেষ পরিণতি হিসাবে আমার জন্য ক্ষতি হয় বলে জানেন; তা হলে আপনি তা আমার থেকে সরিয়ে নিন এবং আমাকে তা থেকে ফিরিয়ে রাখুন। আর আমার জন্য কল্যাণ নির্ধারিত রাখুন; তা যেখানেই হোক। এরপর সে বিষয়ে আমাকে রাজী থাকার তৌফিক দিন। তিনি ইরশাদ করেন, هَذَا الأَمْر এর স্থলে তার প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করবে।-সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৬৬

বিবাহও একটি বৈধ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিবাহের মাধ্যমে সূচনা হয় লম্বা এক জীবনসফর! যার সাথে সেই সফর আপনি করতে চলছেন, আপনার জন্য তা কল্যাণকর হবে নাকি অকল্যাণকর হবে, তা নিশ্চিত করার জন্য ইস্তিখারা করুন। বিবাহের ব্যাপারে উভয় পরিবারের কথাবার্তা যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যাবে, তখন পাত্র-পাত্রীর দেখা-সাক্ষাতের পর্ব আসবে। তাদের দেখা সাক্ষাতের পরে পাত্র-পাত্রী উভয়েই ইস্তিখারা করবে। ইস্তিখারার পরে মনের ঝোঁক যেদিকে থাকবে, সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত জানাবে। তবে জেনে রাখা দরকার, ইস্তিখারার পরে স্বপ্নে কোনো কিছু দেখা গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ হলো, মনের ঝোঁক। যদি মন সায় দেয়, তাহলে আল্লাহ তাআলার উপর তাওয়াককুল করে বিবাহের পক্ষে মতামত দিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু যদি মনের ঝোঁক না থাকে, তবে এই জায়গায় বিবাহ না করা উচিত। ভদ্রভাবে ছেলে/মেয়ের পরিবারকে নিজের অমত জানিয়ে দেওয়া উচিত।

পারিবারিক প্রস্তুতি

পারিবারিক প্রস্তুতির অধীনে যে-সব বিষয় আলোচনায় আসতে পারে, তা হলো

১. অভিভাবকদের পাত্র-পাত্রীকে সহযোগিতার মানসিকতা রাখা।

২. বিবাহের প্রস্তাব গ্রহণ-বর্জনে পাত্রীর মতামতের গুরুত্ব।

৫. মোহর নির্ধারণে ভারসাম্য মানসিকতা।

১. অভিভাবকদের পাত্র-পাত্রীকে সহযোগিতার মানসিকতা রাখা

প্রথমে জেনে নেই ইসলামের দৃষ্টিতে অভিভাবক কারা। ইসলামের দৃষ্টিতে অভিভাবক হলো যথাক্রমে পিতা, দাদা, ছেলে, ভাই, চাচা, মা, দাদি, মেয়ে, বোন, মামা, খালা ইত্যাদি। তাদের মাঝে পিতা ও দাদার মর্যাদা সর্বাগ্রে। তারা থাকা অবস্থায় অন্যদেরকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে না।-আল-লুবাব ফী শরহিল কিতাব ৪/২২

 

পারিবারিক প্রস্তুতি বলতে বোঝাচ্ছি, পাত্র-পাত্রীর পরিবারের অভিভাবকগণ তাদেরকে বিবাহের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবেন। নিজেদের ছেলে/মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র/পাত্রী নির্বাচন করা, বিবাহের প্রস্তাব দেওয়া, পরিবারের মাহরাম মহিলাদের মেয়ে দেখতে পাঠানো, ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্য সম্মানজনক মোহর নির্ধারণ করাসহ বিবাহের সার্বিক ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীকে তারা সহযোগিতা করবেন।

. বিবাহের প্রস্তাব গ্রহণবর্জনে পাত্রীর মতামতের গুরুত্ব

অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় বিবাহের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের একটি মারাত্মক অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। আর তা হলো, বিবাহের প্রস্তাব গ্রহণ-বর্জনে পাত্রীর মতামতকে অগুরুত্বপূর্ণ মনে করা, অবহেলা করা, যা নিতান্তই গর্হিত একটি অপরাধ! যার কারণে অনেক সময় অপাত্রে পাত্রস্থ করার কারণে মেয়েটির জীবন নরকে পরিণত হয়। পরবর্তীতে সারাজীবন মেয়ের কাছে অভিভাবকগণ অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হন। পাত্রীর মনমতো পাত্র নির্বাচনে অবহেলা করার কারণে তার কাছে অভিভাবকগণ জালিম রূপে থেকে যান। অথচ ইসলামে পাত্রীর মতামতকে বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

{وَإِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَبَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَلَا تَعْضُلُوهُنَّ أَنْ يَنْكِحْنَ أَزْوَاجَهُنَّ إِذَا تَرَاضَوْا بَيْنَهُمْ بِالْمَعْرُوفِ ذَلِكَ يُوعَظُ بِهِ مَنْ كَانَ مِنْكُمْ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكُمْ أَزْكَى لَكُمْ وَأَطْهَرُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ}.

তোমরা যখন নারীদেরকে তালাক দেবে, তারপর তারা ইদ্দত পূর্ণ করবে, তখন (হে অভিভাবকেরা!) তোমরা তাদেরকে এ কাজে বাধা দিয়ো না যে, তারা তাদের (প্রথম) স্বামীদেরকে (পুনরায়) বিবাহ করবে যদি  তারা পরস্পরে ন্যায়সম্মতভাবে একে অন্যের প্রতি রাজি হয়ে যায়। এর দ্বারা তোমাদের মধ্যে সেই সব লোককে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান রাখে। এটাই তোমাদের পক্ষে বেশি শুদ্ধ ও পবিত্র পন্থা। আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।-সূরা বাকারা (২) : ২৩২

তাফসীরে তাওযীহুল কোরআনে আল্লামা তাকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, অনেক সময় তালাকের পর ইদ্দত পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর স্বামী-স্ত্রীর শিক্ষা লাভ হত, ফলে তারা নতুনভাবে জীবন শুরু করার জন্য পরস্পরের পুনরায় বিবাহ সম্পন্ন করতে চাইত। সেহেতু তালাক তিনটি হতে না, তাই শরীয়তে নতুন বিবাহ জায়েয ছিল এবং স্ত্রী তাতে সম্মত থাকত, কিন্তু তার আত্মীয়স্বজন নিজেদের কাল্পনিক অহমিকার কারণে তাকে তার প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধা দিত আয়াত তাদের সে ভ্রান্ত ধারণাকে অবৈধ সাব্যস্ত করেছেতাফসীরে তাওযীহুল কুরআন, সূরা বাকারার ২৩২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা

খানসা বিনতে খিযাম আল আনসারিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুা, তিনি বয়স্কা ছিলেন। তাঁর পিতা তাঁকে বিবাহ দেন তাঁর অমতেই! এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর কাছে  তিনি এই ব্যাপারে অভিযোগ করেন। নবিজি মেয়ের মত না থাকার কারণে এই বিবাহ বাতিল করে দেন।-সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৭৬৬

রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন,

>لاَ تُنْكَحُ الأَيِّمُ حَتَّى تُسْتَأْمَرَ، وَلاَ تُنْكَحُ البِكْرُ حَتَّى تُسْتَأْذَنَ، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَكَيْفَ إِذْنُهَا؟ قَالَ: >أَنْ تَسْكُتَ<.

কোন বিধবা নারীকে তার সম্মতি ছাড়া শাদী দেয়া যাবে না এবং কুমারী মহিলাকে তার অনুমতি ছাড়া শাদী দিতে পারবে না। লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! কেমন করে তার অনুমতি নেব। তিনি বললেন, তার চুপ করে থাকাটাই তার অনুমতি।-সহীহ বুখারী, হাদীস ৫১৩৬

উপরিউক্ত কোরআনে কারীমের আয়াত এবং দু’টি হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো, প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে তার অমতে বিবাহ দেওয়া অবৈধ! এতে অভিভাবকদের জুলুমের গুনাহ হবে! নিজেদের আত্মম্ভরিতা দেখাতে গিয়ে মেয়ের মতামতকে পরোয়া না করা জাহিলি যুগের কাজ, কোরআনে কারীমের আয়াত থেকেও তা বোঝা গেল।

. মোহর নির্ধারণে ভারসাম্য মানসিকতা

মোহর মূলত স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর প্রতি এক ধরনের সম্মাননা। মোহর নারীর কোনো মূল্য নয়, কেউ এমন ধারণা করে থাকলে তার ধারণা নিতান্তই অমূলক! মোহরের ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা হলো, মোহর এতো কম নির্ধারণ না করা, যে পরিমাণ এই পাত্রীর ক্ষেত্রে সমাজে সম্মানজনক বিবেচনা করা হয় না। আবার এতো বেশিও না হওয়া চাই, যা পাত্রের পক্ষে আদায় করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।

মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ দশ দিরহাম বা ৩০.৬১৮ (দুই তোলা সাড়ে সাত মাশা রূপা) গ্রাম রূপা। মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে আর্থিকভাবে একেবারেই দুর্বল পাত্রের দিক বিবেচনা করে। এজন্য নির্ধারণ করা হয়নি যে, এই পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা সর্বাবস্থায় সর্বোত্তম!

নারীর মৌলিক অধিকার হলো মোহরে মিসিল। তার বাবার বংশের অন্যান্য নারীর মোহর যে পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে, সেই পরিমাণ মোহরকে মোহরে মিসিল বলা হয়। একজন নারী চাইলে বিয়েতে মোহরে মিসিল দাবি করতে পারে। এতে দোষের কিছু নেই। তবে তার সম্মতিতে এর থেকে কম পরিমাণ মোহরও নির্ধারণ করা জায়েয আছে।

মোহরে ফাতিমীর পরিমাণ হলো ১৩১.২৫ তোলা রূপা। নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রাণপ্রিয় কন্যা ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার মোহর যে পরিমাণ নির্ধারণ করেছিলেন, সেই পরিমাণ মোহরকে মোহরে ফাতিমী বলা হয়। অনেকেই মোহরে ফাতিমীকে সর্বোত্তম মোহর মনে করেন, এই ধারণাও একটি অমূলক ধারণা! তবে যদি খেয়াল এমন থাকে যে, নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রাণপ্রিয় কন্যার জন্য এই পরিমাণ নির্ধারণ করেছিলেন, এজন্য ইত্তেবায়ে সুন্নতের আশায় এই পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এতে সওয়াবের আশা করা যায়। তবে আমরা পূর্বে বলে এসেছি যে, মোহরের ক্ষেত্রে নারীর সম্মান এবং পুরুষের সাধ্যের বিবেচনা করা উচিত, তা যে-ই পরিমাণই হোক না কেন। এটাই ভারসাম্যপূর্ণ ও উত্তম পন্থা। কারণ, মোহর কেবল লোক দেখানোর জন্য নয়, কালো কালিতে কাগজের পাতায় পড়ে থাকার জন্য নয়,বরং আদায়ের জন্যই মোহর নির্ধারণ করা হয়।-দ্রষ্টব্য, বিয়ে ও তালাকের শরয়ী রূপরেখা, মূল, মুফতী তাকী উসমানী হাফি. অনুবাদ, মুফতী শাব্বির আহমাদ, পৃ. ৬১-৬৩

সামাজিক প্রস্তুতি

সামাজিক প্রস্তুতি বলতে বোঝানো হচ্ছে, সমাজের লোকদের বিবাহ সম্পর্কে অবগত করা। দু’জন নারী-পুরুষ একই ছাদের নীচে একসাথে বৈধভাবে বসবাস করছে, বিষয়টি সমাজের লোকদের যেন বোধগম্য হয়। হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, সব নবী এবং ইমামগণ এ ব্যাপারে একমত যে, বিবাহের ব্যাপক প্রচারণা করা হবে, যাতে দর্শকদের সামনে বিবাহ এবং ব্যভিচারের মাঝে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে যায়। এজন্য বিবাহে সাক্ষী নির্ধারণ করা হবে এবং ব্যাপকভাবে প্রচারের স্বার্থে ওয়ালিমার ব্যবস্থা করা হবে এবং এতে কিছু লোকদেরকে দাওয়াত দেওয়া হবে। যাতে সবাই বিবাহ সম্পর্কে অবগত হয়, পরবর্তীতে যাতে কোনো সমস্যা না দেখা দেয়।-আহকামে ইসলাম আকল কে নযর মে, পৃ. ১৫৬

বিবাহের আকদ: নতুন জীবনের সূচনায় করণীয়বর্জনীয়

এতো ধাপ পেরিয়ে অবশেষে আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! দু’জন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ যে সময়ের পরে একে অপরের চিরআপন হয়ে যায়। একেবারে অচেনা মানুষ দু’টি একে অপরের চিরচেনা হয়ে যায়। সেই মাহেন্দ্রক্ষণের সূচনাবিন্দু হলো বিবাহের আকদ। আকদের সঠিক পদ্ধতি কী, এই প্রশ্নের উত্তরে এবার আসা যাক।

বিবাহের আকদ কীভাবে পড়ানো হয়

বিবাহের আকদে কমপক্ষে দু’জন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ এবং দু’জন নারী থাকা আবশ্যক।-সূরা বাকারা (২) : ২৮২

সাক্ষীদের সামনে বিবাহ পড়ানো হবে। ইজাব-কবুলের (প্রস্তাব এবং সম্মতিসূচক) শব্দাবলী এমন জোরে উচ্চারণ করতে হবে যাতে সাক্ষীরা তা শুনতে পায়।-রদদুর মহতার মাআদ দুররিল মুখতার ৮/৭৭

পাত্র-পাত্রী উভয়েই সাক্ষীদের সামনে ইজাব-কবুল করে নিলেই বিবাহ সম্পাদিত হয়ে যাবে। অথবা পাত্রীর অভিভাবক পাত্রীর কাছ থেকে ইযিন (অনুমতি) নিয়ে আসবে এই বলে যে, “আমার মেয়ে! অমুকের ছেলে এতো টাকা মোহরে তোমাকে বিবাহ করতে চাচ্ছে। তুমি কি এতে সম্মত আছ?” পাত্রী এই কথার জবাবে মুচকি হাসলে অথবা স্বজনদের ছেড়ে যাওয়ার বিরহে কান্না করলে অথবা কিছু না বলে চুপ থাকলেই তার সম্মতি আছে বলে ধরা হবে। তবে সুস্পষ্ট ভাষায় অসম্মতি প্রকাশ করলে তখন সম্মতি আছে বলে ধরা হবে না। বরং এই প্রস্তাবে পাত্রী রাজি নয় ধরা হবে। আর তার অসম্মতিতে বিবাহ হবে না।-প্রাগুক্ত ৮/১৯৮-২০০

তবে ইযিন নেওয়ার জন্য কোন সাক্ষী লাগবে না। প্রাগুক্ত ৮/৩২৩

আবার গায়রে মাহরাম কেউ পাত্রীর ইযিন নেওয়ার জন্য তার সামনে যাবে না। তখন পর্দা রক্ষা না করার কারণে গুনাহ হবে। পর্দার আড়ালে থেকে তার কাছ থেকে অনুমতি নেবে। পাত্রীর অনুমতি নেওয়ার পরে আকদের মজলিস হবে। আকদের মজলিসে বিবাহ পড়ানোর পূর্বে বিবাহের খুতবা দেওয়া সুন্নত, জরুরি না। বিবাহের খুতবা হলো

الْحَمْدُ لِلَّهِ نَسْتَعِينُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ وَنَعُوذُ بِهِ مِنْ شُرُورِ أَنْفُسِنَا، مَنْ يَهْدِ اللَّهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُضْلِلْ فَلَا هَادِيَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا {اتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا}، {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ}، {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا}.

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আমরা তাঁর কাছেই সাহায্য চাই, এবং তাঁর নিকটই ক্ষমা প্রার্থনা করি। এবং তাঁর নিকট অন্তরের কুমন্ত্রণা থেকে পানাহ্ চাই, যাকে আল্লাহ্ পথ প্রদর্শন করেন তাকে গোমরাহ্ করার কেউ নেই। আর আল্লাহ্ যাকে গোমরাহ্ করেন তাকে পথ প্রদর্শনের কেউ নেই। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর বান্দা ও রাসূল।

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচঞা কর এবং সতর্ক থাক জ্ঞাতিবন্ধন সম্পর্কে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমাদের উপর তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর যথোপযুক্তভাবে ভয় করার মত এবং মুসলিম না হয়ে তোমরা মৃত্যুবরণ করো না।

হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বলো, (তবে আল্লাহ্) তোমাদের কর্ম সংশোধোন করবেন এবং তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, অবশ্যই সে বিরাট সাফল্য লাভ করবে।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২১১৮; হাদীসটি সহীহ।

খুতবা পাঠের পরে পাত্রীর বাবা বা তার ওয়াকিল বিবাহের মজলিসে প্রস্তাব পেশ করবে এই বলে যে, আমি আমার মেয়েকে/মুয়াক্কিলাকে তোমার সাথে এতো টাকা মোহরে বিবাহ দিলাম আর পাত্র আমি কবুল করলাম” কবুল করে নিবে, এতেই বিবাহ সম্পাদিত হয়ে যাবে। প্রথম কথা যে পক্ষ বলবে, এই কথাকে ধরা হবে ইজাব আর পরে যে পক্ষ বলবে এই কথাকে ধরা হবে কবুল।-আল ফিকহুল হানাফী ফী ছিাওবিহিল জাদীদ ২/৬০

স্মর্তব্য যে, উকিল বাবা বলতে কোনো ধারণা ইসলামে নেই!-প্রচলিত ভুল /৫৯৬০

বিবাহে যা বর্জনীয়

ইসলাম বিবাহকে বেশ সহজ করেছে। কুপ্রথা আর লৌকিকতামুক্ত রেখেছে। কিন্তু হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির প্রভাবে গড়ে ওঠা আমাদের সমাজব্যবস্থা বিবাহে নানা জটিলতা তৈরি করেছে। কুপ্রথার বেড়াজালে খুব সহজ এই বিষয়টিকে! আমাদেরকে এসব অপসংস্কৃতি, ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নীতি পরিহার করতে হবে, এতেই দাম্পত্য জীবন হবে সহজ ও সুখকর। কী কী বিষয় পরিহার করা জরুরি, তা নিয়ে আলাপ করতে গেলে যেসব বিষয় সামনে আসে, তা হলো

১. গায়ে হলুদ

২. এনগেজমেন্টের নামে পাত্র-পাত্রীকে একে অপরকে আংটি পরিয়ে দেওয়া

৩. কনে পক্ষের কাছে সুস্পষ্ট ভাষায় অথবা ইঙ্গিতে যৌতুক চাওয়া।

৪. পাত্রীর পরিবারের উপর নির্দিষ্ট সংখ্যক বরযাত্রীকে আপ্যায়নের শর্ত করা।

৫. বিয়ের অনুষ্ঠানে বেপর্দা নারীদের উপস্থিতি

৬. অনুষ্ঠানস্থলে টেবিল বসিয়ে উপহার নেওয়ার নামে দাওয়াতগ্রহণকারীদের মানসিক চাপে রাখা

৭. গরীবদের পরিহার করে কেবল ধনীদের দাওয়াত দেওয়া।

৮. মসজিদে আকদের সময় শোরগোল করে মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট করা

৯. বিভিন্ন মৌসুমে মৌসুমি ফল পাঠাতে কনেপক্ষকে চাপাচাপি করা

১০. রমজান মাসে ইফতারি পাঠানোর জন্য বলা

বিভিন্ন অঞ্চলে আরো নানান কুপ্রথা রয়েছে, এসব আবশ্যিকভাবে পরিহার করতে হবে। এতেই সব পক্ষের জন্য শান্তি ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

বিয়েতে যা যা করা যাবে

১. বরযাত্রীদের আপ্যায়ন করানো কনেপক্ষের উপর জরুরিও নয়, নিষিদ্ধ নয়। তারা যদি বরপক্ষের কোন ধরনের চাপাচাপি ছাড়াই স্বেচ্ছায় কিছু মানুষকে মেহমানদারি হিসেবে আপ্যায়ন করায়, এতে দোষের কিছু নেই। অবশ্য ইসলামি দৃষ্টিকোণে মৌলিকভাবে কনেপক্ষের উপর বরপক্ষকে আপ্যায়নের কোনো খরচ নেই এবং ইসলামের সোনালী যুগেও বরযাত্রার এমন নিয়ম পাওয়া যায় না। তাছাড়া বর্তমান সময়ে বরযাত্রা একটি প্রথাসর্বস্ব বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে বরযাত্রার বাহারি কত আয়োজন করা হয়, তার কোনো ইয়ত্তা নেই! এজন্য সব ধরনের কুপ্রথা ও লৌকিকতা মুক্ত থেকে বরযাত্রীকে আপ্যায়ন করা যাবে। অন্যথায় না করানোই ভালো।-ইসলাম ও আমাদের জীবন ৫/৮৩

২. পাত্রীর বাবা-ভাই কিছু না বললেও পাত্রীকে বিবাহ দেওয়ার সময় তাদের সাধ্যমতো উপঢৌকন দিতে পারে। মেয়ে/বোন বড় আবেগের জায়গা। নিজের কলিজার টুকরোকে খালি হাতে অন্যের বাড়িতে কেউই পাঠাতে চায় না। এজন্য কনের অভিভাবক স্বেচ্ছায় কিছু উপঢৌকন দিতে পারে। নিজের মেয়েকে তো দিতে পারবেই, পাত্রকেও দিতে পারবে। তবে পাত্রপক্ষের চাপাচাপি অথবা প্রথা হিসেবে দেওয়ার সুযোগ নেই। যদি বোঝাযায়, কনেপক্ষ বাধ্য হয়ে কিছু দিচ্ছে, তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সন্তুষ্টি নেই, তবে এমন উপঢৌকন নেওয়া মোটেও বৈধ নয়। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

>لَا يَحِلُّ لِامْرِئٍ أَنْ يَأْخُذَ عَصَا أَخِيهِ بِغَيْرِ طِيبِ نَفْسٍ مِنْهُ قَالَ: وَذَلِكَ لِشِدَّةِ مَا حَرَّمَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ عَلَى الْمُسْلِمِ مِنْ مَالِ الْمُسْلِمِ<.

সন্তুষ্টি ছাড়া কারো সম্পদ ব্যবহার করা বৈধ নয়।-শরহু মুশকিলীল আসার, হাদীস ২৮২২; হাদীসটির সনদ হাসান।

. ওয়ালিমা করা

ওয়ালিমা করা শুধু বৈধই নয়, বরং সুন্নাহ। ইসলামের পূর্বে জাহিলি যুগেও ওয়ালিমার এই নিয়ম চালু ছিল। ইসলামও এই নিয়ম চালু রেখেছে। কারণ ওয়ালিমার বেশ কিছু উপকার রয়েছে, যেমন

১. সামাজিক উপকার:

ওয়ালিমায় লোকদেরকে দাওয়াত দেওয়ার অর্থ হলো, দু’জন নারী পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে এবং তারা একসাথে একই ছাদের নীচে বসবাস করবে, এই নারীর ঘরে সন্তান হলে তার বাবা হবে ঐ পুরুষ; এই বিষয়গুলো সমাজের মানুষের মাঝে প্রচার করা। বিষয়গুলো তাদের কাছে সুস্পষ্ট থাকা। যাতে পরবর্তীতে কোনো গণ্ডগোল সৃষ্টি না হয়।

২. পারিবারিক উপকার: মানুষের জীবনে বহু প্রয়োজন দেখা দেয়। আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে সেসব প্রয়োজন করেন। এজন্য বান্দাদের দায়িত্ব, আল্লাহ তাআলার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। সাংসারিক কাজ সম্পাদনা করার জন্য নারীজাতির প্রয়োজন অনস্বীকার্য। একজন নারী আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করে আপনার সংসারে উপহার হিসেবে দিয়েছেন। এজন্য আপনার দায়িত্ব, আল্লাহ তাআলার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। আর ওয়ালিমা হলো কৃতজ্ঞতা প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

৩. নববধূ ও তার পরিবারের সাথে উত্তম আচরণ: ওয়ালিমার মাধ্যমে নববধূ ও তার পরিবারের সাথে উত্তম আচরণ করা হয়। কারণ, নববধূর জন্য অর্থ সম্পদ ব্যয় করা এবং অনুষ্ঠান করে লোকদেরকে একত্রিত করা প্রমাণ করে নববধূ এবং তার পরিবার আপনাদের কাছে কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সাথে সম্বন্ধ করে আপনারা আনন্দিত। তাদের সাথে উত্তম আচরণের অন্যতম মাধ্যম হলো ওয়ালিমা করা।

৪. আত্মাকে কলুষতা থেকে পবিত্র করা

কৃপণতা আত্মার অন্যতম ব্যাধি। সম্পদ ব্যয়ে কৃপণতা হৃদয়কে কলুষিত করে। যখন নববধূকে জীবনসঙ্গী হিসেবে খুশি-আনন্দের দাবি হলো, সম্পদ ব্যয় করা। সম্পদ ব্যয় করার মাধ্যমে আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা হলো। হৃদয়ও কৃপণতার কলুষতা থেকে পবিত্র হলো।-রহমাতুল্লাহিল ওয়াসিআহ ৫/৭৮

সবচেয়ে বড় কথা হলো, নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও ওয়ালিমা করেছেন, সাহাবায়ে কেরামদেরকেও উৎসাহিত করেছেন। আবদুর রহমান বিন আউফ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে লক্ষ্য করে নবিজি বলেছিলেন,

>أَوْلِمْ وَلَوْ بِشَاةٍ<.

একটি ছাগল দিয়ে হলেও ওয়ালিমা করো।-সহীহ বুখারী, হাদীস ২০৪৮

দরিদ্র ব্যক্তি সর্বোচ্চ সামর্থ্য এবং ধনীর সর্বনিম্ন সামর্থ্য হলো ছাগল, এই কথার প্রতি ঈঙ্গিত করে হাদীসে ছাগলের কথা এসেছে। বাসর রাতের পরে ওয়ালিমা করাই নিয়ম, তার আগে নয়। নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল এমনই ছিল। মোটকথা, প্রত্যেকেই সাধ্যমতো সম্পদ ব্যয় করে ওয়ালিমার আয়োজন করা উচিত।

কোনো সমস্যা না থাকলে ওয়ালিমার দাওয়াত গ্রহণ করা উচিত। এতে একটি বরকতময়, সুন্নাহসম্মত অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার সওয়াব ও সৌভাগ্য অর্জিত হয়। তবে ওয়ালিমার দাওয়াত গ্রহণ করে কোনো কারণ ছাড়া না যাওয়া দাওয়াত প্রদানকারীর খাবার নষ্ট করার নামান্তর। এমন কাজ করা নীচু মানসিকতার প্রমাণ। এজন্য দাওয়াত গ্রহণ করে কোনো সমস্যা না থাকলে উপস্থিত থাকা নৈতিক দায়িত্ব। এমনকি দাওয়াত আগে দেওয়া হয়ে থাকলে ওয়ালিমার দিন নফল রোজা রাখবে না। পরবর্তীতে রাখবে।-রাহমাতুল্লাহিল ওয়াসিয়াহ ৫/৮১

 

লেখক, মাওলানা আবু রুফাইদা ইমরান

লেখক, গবেষক ও শিক্ষক

উস্তায, জামিয়া মাদানিয়া কাওমিয়া শেখ এম এ জব্বার কমপ্লেক্স, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, সিলেট, বাংলাদেশ।

#Leave A Comment

#Leave A Comment