পরিবারনীতি – পর্ব-৪
দাম্পত্যকলহ: কারণ ও প্রতিকার
- তালাক: কখন, কেন, কীভাবে, তালাক সম্পর্কে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা
- দাম্পত্যকলহ: কারণ ও প্রতিকার
আমাদের শরীরে যেমন অসুখ বাঁধলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, এমনকি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে মৃত্যু পর্যন্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে, ঠিক তেমনই দাম্পত্যকলহ সৃষ্টি হলে সংসারের ভীত দুর্বল হয়ে যায়, এমনকি সুখের সংসারে অশান্তির আগুনে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যায়! শরীরকে সুস্থ রাখতে হলে যেভাবে রোগ এবং রোগের প্রতিষেধক সম্পর্কে পূর্বধারণা থাকা জরুরি, ঠিক তেমনই সংসারকে টেকসই ও মজবুত রাখতে হলে দাম্পত্যকলহের কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে আগে থেকে জেনে রাখা দরকার। বিপদ আসার পরে সতর্ক হওয়ার চেয়ে বিপদ আসার আগেই আসন্ন বিপদের ব্যাপারে জানা এবং তার বিপদমুক্তির পথ খুঁজে নেওয়া নিঃসন্দেহে অধিক কল্যাণকর। চতুর্থ অধ্যায়ে তো আমরা সুখী পরিবার নির্মাণে করণীয় নিয়ে আলোচনা করেছি। এবার সুখী পরিবার নির্মাণে প্রতিবন্ধক দাম্পত্য কলহের অনুঘটক বিষয়াদি ও এসবের প্রতিকার নিয়ে আলাপ করবো ইনশাআল্লাহ।
দাম্পত্যকলহ সৃষ্টির পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এসবের মধ্যে মৌলিক কিছু কারণ রয়েছে। মৌলিক কারণ হিসেবে তিনটি বিষয় আলোচনায় আসতে পারে
১. ভুল জীবনসঙ্গী নির্বাচন
২. সামাজিক বিশৃঙ্খলা
৩. স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তৃতীয়পক্ষের অনুপ্রবেশ
১. ভুল জীবনসঙ্গী নির্বাচন
দাম্পত্য জীবনকে সুখী করতে সঠিকভাবে পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করতে হবে। আপনি যদি ঠিক মানুষটিকে আপনার জীবনসঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করতে পারেন, তবে দাম্পত্য জীবনে নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে হলেও ইনশাআল্লাহ সংসারে সুখ আসবে। দু’জন দু’জনার হাত ধরে সব বাধার প্রাচীর পেরিয়ে গন্তব্যপানে ছুটে চলতে পারবেন নিরন্তর। কিন্তু যদি ভুল মানুষ যদি আপনার জীবনসঙ্গী হয়, তাহলে দাম্পত্য জীবনে কলহ সৃষ্টি হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র! এজন্য শুধু রূপ অথবা টাকা দেখে বিয়ে করার পরিণতি সুখকর হয় না সাধারণত। আপনার জীবনসঙ্গী যদি দ্বীনদার না হয়, তাহলে পাপের পঙ্কিল পথে আপনার জীবন আটকে যাবে। যদি দু’জনের চিন্তা ও টার্গেট এক না হয়, তাহলে সময়ে সময়ে ঝগড়া বাধবে নিশ্চিত! যদি দু’জনের জীবন-যাপন পদ্ধতি ভিন্ন হয়, তবে সময়ে সময়ে আপনি হুঁচট খাবেন জেনে রাখেন। এজন্য পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করতে গিয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকুন। এই সমস্যার মূলে আঘাত করুন শুরুতেই। জীবনসঙ্গী হিসেবে সেই মানুষকেই নির্বাচন করুন, যার সাথে আপনার সার্বিকভাবে মিল হবে বলে আপনার প্রবল ধারণা হবে। পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের বেলায় কী কী লক্ষ্যণীয়, তা তো পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। সেই নিয়ম অনুযায়ী জীবনসঙ্গী নির্বাচন করুন, ইনশাআল্লাহ ভুল মানুষটি আপনার জীবনসঙ্গী হবে না।
২. সামাজিক বিশৃঙ্খলা
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে তার বসবাস। সমাজ নিয়েই তার চলাফেরা। সাধারণত সমাজের প্রভাবে সেও প্রভাবিত হয়। সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ একেকটি পরিবার। সমাজ যদি উন্নত চরিত্রের রঙে রঙিন হয়, তাহলে পরিবারে সুখ আসবে। সমাজ যদি বহুমাত্রিক কলঙ্কে কলঙ্কিত হয়, তবে পরিবারেও তার প্রভাব পড়বে। অশান্তি, অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হবে। এই ভিত্তিতে বলা যায়, সমাজে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পেলে পরিবারও এতে আক্রান্ত হয়। শান্তি-শৃঙ্খলার সংসারে বিশৃঙ্খলা-অশান্তি হানা দিতে থাকে। এখন কথা হলো, সামাজিক বিশৃঙ্খলা বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর হলো, সামাজিক বিশৃঙ্খলা বলতে সমাজে বদদ্বীনী বেড়ে যাওয়া। শরীয়ার সাথে সাংঘর্ষিক কাজকর্ম বৃদ্ধি পাওয়া। চারিত্রিক স্খলনের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়া।
আমাদের সমাজগুলোতে ইদানিং মাত্রাতিরিক্ত হারে বিশৃঙ্খলা বেড়ে চলছে। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা এখন সবখানে বিদ্যমান! নারীদের বেপর্দা চলাফেরায় যুবকরা বিপথগামী হচ্ছে নিয়মিত! নাটক, সিনেমার নামে নারীদের প্রদর্শনীর জয়জয়কার চলছে সবখানে! পর্নোগ্রাফির মহামারিতে সয়লাব হয়ে গেছে সমাজ! হস্তমৈথুন আর অশ্লীলতার জোয়ার বইছে চতুর্দিকে! ঘরের বাইরে বেপর্দা নারীদের অর্ধনগ্ন দেহ দেখে পুরুষ মানুষ নিজের স্ত্রীর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। পর্নোগ্রাফির অবাস্তব অভিনয় দেখে নিজের প্রতি আস্থা হারাতে বসেছে যুবসমাজ! নিজের সরল সহজ জীবনসঙ্গিনীর রূপে তৃপ্ত হতে পারছে না তারা!
পর্নোগ্রাফি তাদেরকে যৌননেশার এক অবাস্তব চোরাবালিতে আটকে দিয়েছে! এ-সব সামাজিক বিশৃঙ্খলার কারণে পরিবারে পরিবারে অশান্তি বিরাজ করছে! দাম্পত্যকলহ বেড়ে গেছে। পরকীয়া বেড়ে গেছে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য তৈরি হচ্ছে! পত্রপত্রিকায় ডিভোর্সের পরিসংখ্যানই জানান দিচ্ছে সামাজিক বিশৃঙ্খলা কী পরিমাণ বিশাল আকার ধারণ করেছে।
এজন্য আমাদেরকে সমাজ সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ম্যান টু ম্যান দাওয়াহ বাড়াতে হবে। ওয়াজ মাহফিলে পর্নোগ্রাফি, সিনেমা-নাটক এবং বেপর্দা চলাফেরা করার ভয়াবহ ক্ষতি নিয়ে আলাপ করতে হবে। যুবকদের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। চরিত্র গঠনমূলক সেমিনার সিম্পোজিয়ামের ব্যবস্থা করতে হবে। অশ্লীলতার ভয়াবহ সামাজিক ক্ষতি নিয়ে লিফলেট বিতরণ করতে হবে। সর্বোপরি সবাইকে তাওবাহর দাওয়াত দিতে হবে। সামাজিক বিশৃঙ্খলা দূর করতে আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করতে হবে। ইনশাআল্লাহ এভাবেই সামাজিক বিশৃঙ্খলা দূর হবে। গড়ে ওঠবে একটি পরিশুদ্ধ সমাজব্যবস্থা।
৩. স্বামী-স্ত্রীর মাঝে তৃতীয়পক্ষের অনুপ্রবেশ
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা আল্লাহ তাআলার বিশেষ দান। তারা একে অপরের পরিপূরক। একজন ছাড়া আরেকজন অপূর্ণ। তাদের মাঝে পারষ্পরিক সহযোগিতার মনোভাব থাকবে। সহমর্মিতা থাকবে। এই সম্পর্কে একজনের সুখ কেবল একজনের না, বরং দু’জনের। দুঃখ এখানে কেবল একজনের না, বরং দু’জনের। এভাবেই পরষ্পর মিলেমিশে সংসার পরিচালনা করলে পরিবারে সুখ আসবে। জীবনে কোনো ঝড়ঝাপটা আঘাত হানলে একসাথে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যাবে।
স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে কেবল ভালোবাসা আর মাখামাখির সম্পর্ক সবসময় হয়ে ওঠে না। কোনো কোনো সময় রাগারাগি, মনকষাকষি হতে পারে। এমন কিছু ঘটলে তারাই সেটা সমাধান করবে। তাদের মাঝে তৃতীয়পক্ষ অনুপ্রবেশ করা মোটেও সমীচীন নয়। এতে অনেক সময় সমস্যা সমাধানের বদলে আরো বড় আকার ধারণ করে। বিশেষকরে স্বামী বা স্ত্রীর নারী আত্মীয়দের কেউ ঢুকলে তিলকে তাল বানাতে সময় লাগে না! এজন্য স্বামী-স্ত্রীর সাধারণ মনোমালিন্যে কেউ অনুপ্রবেশ করবে না। স্বামীর বাবা-মা, স্ত্রীর বাব-মা বা অন্য কেউ মোটেও নাক গলাতে যাবে না। তাদের মনোমালিন্য তারা মিটিয়ে নিতে অভ্যস্ত। অবশ্য মনোমালিন্য বড় আকার ধারণ করলে ভিন্ন কথা।-আল-ফিকহুল হানাফী ফি চাওবিহিল জাদীদ ২/১৪৫-১৪৬
স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্যে করণীয়
সামগ্রিকভাবে দাম্পত্য কলহের বিভিন্ন কারণ ও তার প্রতিকার নিয়ে এ পর্যন্ত আলোচনা হলো। এখন কথা হল, যদি স্বামী স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়, তাদের মধুর সম্পর্ক খারাপ হওয়ার উপক্রম হয়, তখন কী করণীয়? স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য সৃষ্টির পেছনে স্বামী যেমন দায়ী হতে পারে, ঠিক তেমনই স্ত্রীও দায়ী হতে পারে। ভুলটি মূলত কার, এই প্রশ্নের উপর ভিত্তি করে এই সংকটের সমাধান দিতে হবে।
স্বামীর ভুলে স্ত্রীর করণীয়
দাম্পত্য জীবনে সমস্যা সৃষ্টির পেছনে স্বামী যদি দায়ী হয়, তবে স্ত্রীর কিছু দায়িত্ব থাকে—
১. স্ত্রীর অবস্থান সঠিক হলেও স্বামীর সাথে সে রাগ দেখাবে না। এতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে!
২. স্বামীর খারাপ আচরণে ধৈর্য ধারণ করবে।
৩. একান্ত সময়ে স্বামীকে বোঝাবে। একান্ত সময় পুরুষদের দুর্বলতার সময়। লোহাও তখন মোমের মতো গলে যায়। এতে ইনশাআল্লাহ স্বামী তার ভুল বুঝতে পারবে। স্ত্রীর প্রতি আবারও তার ভালোবাসা ফিরে আসবে।
৪. তাতেও কাজ না হলে স্ত্রী নিজের অধিকার খর্ব করে হলেও স্বামীর সাথে সন্ধি করে বনিবনা করে নিবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
{وَإِنِ امْرَأَةٌ خَافَتْ مِنْ بَعْلِهَا نُشُوزًا أَوْ إِعْرَاضًا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَنْ يُصْلِحَا بَيْنَهُمَا صُلْحًا وَالصُّلْحُ خَيْرٌ وَأُحْضِرَتِ الْأَنْفُسُ الشُّحَّ وَإِنْ تُحْسِنُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا}.
কোনো নারী যদি তার স্বামীর পক্ষ হতে দুর্ব্যবহার বা উপেক্ষার আশঙ্কা করে, তবে তাদের জন্য এতে কোন অসুবিধা নেই যে, তারা পারস্পরিক সম্মতিক্রমে কোনো রকমের আপোস-নিষ্পত্তি করবে। আর আপোস-নিষ্পত্তিই উত্তম। মানুষের অন্তরে (কিছু না কিছু) লালসার প্রবণতা তো নিহিত রাখাই হয়েছে। তোমরা যদি ইহসান ও তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে তোমরা যা-কিছুই করবে, আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত আছেন।-সূরা নিসা (৪) : ১২৮
ইবনে কাসির রহমাতুল্লাহ আলাইহি বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বামী-স্ত্রীর তিনটি অবস্থা বর্ণনা করেছেন
১. স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অনাসক্তি অবস্থার কথা।
২. তাদের উভয়ের ঐকমত্যের অবস্থা কথা।
৩. তাদের বিচ্ছেদের অবস্থার কথা।
উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রথম অবস্থায় কী করণীয়, তা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এই আয়াতে বলা হয়েছে, স্ত্রীর প্রতি কোনো কারণে স্বামী যদি অনাসক্ত বা বিরাগভাজন হয়, তখন স্ত্রী চাইলে তার খোরপোষ, বাসস্থান বা অন্য কোনো অধিকার ছেড়ে দিতে পারে। এবং স্বামীও তার সাথে সন্ধি করে নিতে পারে। এতে তাদের কোনো গুনাহ হবে না। বরং এটাই তাদের জন্য কল্যাণকর। নিঃসন্দেহে বিচ্ছেদের চেয়ে সন্ধি করা উত্তম।-তাফসীরে ইবনে কাসীর ২/৪২৬
তাফসিরে উসমানীতে বলা হয়েছে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সন্ধি-সম্প্রীতি খুবই ভালো কথা। অবশ্য অযথা স্ত্রীকে জ্বালাতন করা এবং তার সম্মতি ছাড়া তার সম্পদ ব্যয় করা গুনাহ।-তাফসীরে উসমানী, সূরা নিসা ১২৮ নং আয়াতে কারীমরি তাফসীর।
অবশ্য এক্ষেত্রে স্বামীর দায়িত্ব হলো, অনাসক্তির কোনো বাহ্যিক কারণ থাকার পরেও স্ত্রীর সাথে সদ্ব্যবহার করা, তার প্রাপ্য সঠিকভাবে আদায় করা। তার প্রতি বিরাগভাজন না হওয়া। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা তার এই উত্তম আচরণের উত্তম বদলা দিবেন। তিনি তো আমাদের সবার আমল সম্পর্কে সম্যক অবগত।
স্ত্রীর ভুলে স্বামীর করণীয়
কোনো স্ত্রী যদি তার স্বামীর শারীয়াসম্মত নির্দেশ পালন না করে, উল্টো তার সাথে বিরূপ আচরণ করে, তাহলে স্বামীর জন্য তিনটি নির্দেশনা
১. স্ত্রীকে স্বামীর আনুগত্য করার লাভ, আনুগত্য না করার ক্ষতি সম্পর্কে বোঝাবে। সুন্দরভাবে নসীহা করবে। একান্ত সময়ে তাকে বোঝাবে, তোমার এমন আচরণ মোটেও ঠিক হয়নি। আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলের নির্দেশনা তুমি লঙ্ঘন করেছো। তোমার এমন ধরনের আচরণ পরিহার করা উচিত।
২. নসীহায় কাজ না হলে বিছানা আলাদা করে দেবে। তবে একই কামরায় তাকে রাখবে। ভিন্ন কামরায় পাঠাবে না। তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবে।
৩. এতেও কাজ না হলে তাকে হালকা প্রহার করতে পারে। তবে এমনভাবে প্রহার করা যাবে না, যাতে হাড় ভেঙে যায় অথবা শরীরে দাগ বসে যায়। চেহারায়ও আঘাত করবে না।
এই তিনটি পদ্ধতির মধ্যে কোনো একটি পদ্ধতি প্রয়োগ করার পরে যদি স্ত্রী সংশোধিত হয়ে যায়, তবে স্বামী তার উপর নতুন কোনো পদক্ষেপ নিবে না। স্ত্রীর অভিভাবক হিসেবে অযথা কর্তৃত্ব ফলাতে যাবে না। বরং তার ভুল আচরণকে বালুতে লেখা নামের হাতের ইশারায় মুছে দেবে। তাকে আবারও প্রাণভরে ভালোবাসবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
{الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللَّهُ وَاللَّاتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيًّا كَبِيرًا}.
পুরুষ নারীদের অভিভাবক, যেহেতু আল্লাহ তাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু পুরুষগণ নিজেদের অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে। সুতরাং সাধ্বী স্ত্রীগণ অনুগত হয়ে থাকে, (পুরুষের)অনুপস্থিতিতে আল্লাহ প্রদত্ত হিফাজতে (তার অধিকারসমূহ) সংরক্ষণ করে। আর যে সকল স্ত্রীর ব্যাপারে তোমরা অবাধ্যতার আশংকা কর, (প্রথমে) তাদেরকে বুঝাও এবং (তাতে কাজ না হলে) তাদেরকে শয়ন শয্যায় একা ছেড়ে দাও এবং (তাতেও সংশোধন না হলে) তাদেরকে প্রহার করতে পার। অতঃপর তারা যদি তোমাদের আনুগত্য করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো (ব্যবস্থা গ্রহণের) পথ খুঁজো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকলের উপর, সকলের বড়।-সূরা নিসা (৪) : ৩৪
সংকট যখন চরমে পৌঁছে
দোষ স্বামীর হোক বা স্ত্রীর, দাম্পত্য জীবন যখন সংকটময় হয়ে ওঠে, জীবন তখন বিষাক্ত হয়ে পড়ে! শান্তির পায়রা মনে হয় একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে! হারিয়ে গেছে দূর বহুদূর, যেখান থেকে তার ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব!
স্বামী-স্ত্রী উভয়ে সমাধানের বহু চেষ্টা করেও যখন সমাধানে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, বিবাদের কারণে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, তখন তাদের প্রত্যেকের পরিবারের পক্ষ থেকে একজন করে দু’জন দ্বীনদার বুদ্ধিমান সালিশ নির্ধারণ করা হবে। তারা সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে দেখবে। মূল অপরাধী কে, তারা চিহ্নিত করবে। তারপর তাকে অপরাধ থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করবে। তাদেরকে মিলিয়ে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। তারা যদি আন্তরিকভাবে স্বামী-স্ত্রীকে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, আল্লাহ তাআলা তাদের এই মহান কর্মচেষ্টাকে ফলপ্রসূ করবেন ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
{وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِنْ أَهْلِهَا إِنْ يُرِيدَا إِصْلَاحًا يُوَفِّقِ اللَّهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًا}.
তোমরা যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ সৃষ্টির আশঙ্কা কর, তবে (তাদের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য) পুরুষের পরিবার হতে একজন সালিস ও নারীর পরিবার হতে একজন সালিস পাঠিয়ে দেবে। তারা দুজন যদি মীমাংসা করতে চায়, তবে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে জ্ঞাত এবং সর্ববিষয়ে অবহিত।-সূরা নিসা (৪) : ৩৫
এতকিছুর পরও যদি অপরাধী নিবৃত্ত না হয়, তবে তাদেরকে একসাথে রাখা ক্ষতিকর সাব্যস্ত হবে। তাদের মাঝে সম্পর্ক বজায় রাখা তখন ক্ষতির কারণ হবে। এমতাবস্থায় তাদেরকে আলাদা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন দু’জন সালিস। এখন আসবে তালাকের আলোচনা।
তালাক: কখন কেন কীভাবে?
তালাক আরবি শব্দ। তার অর্থ বন্ধন ছিন্ন করা। স্বামী কর্তৃক বৈবাহিক সম্পর্ক নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ছিন্ন করাকে পরিভাষায় তালাক বলে। সম্পর্ক গড়া ভালো, সম্পর্ক ছিন্ন করা খারাপ। অতএব তালাকও মৌলিকভাবে ভালো বিষয় না।
দাম্পত্য জীবনের সূচনা হলো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অটুট ও মজবুত করার লক্ষ্যে। স্বামী-স্ত্রীর মধুর বাঁধন আল্লাহ তাআলার পছন্দ। এজন্য তিনি তাদের মাঝে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তাদের মিলনে বনী আদমের সিলসিলা জারি থাকবে, এ-ই তো বিয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক ঠিক থাকলে ঠিক থাকবে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্ব! তাদের সম্পর্কের মাঝে সংকট সৃষ্টি হওয়া মানে সবখানে সংকট সৃষ্টি হওয়া। এই কারণে বিবাহ মৌলিকভাবে ভালো কাজ। কিন্তু তালাক ভালো কাজ না। অবাধ্য স্ত্রী যদি শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে যায়, তবে তাকেও তালাক না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে কোরআনে কারীমে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
{الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللَّهُ وَاللَّاتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيًّا كَبِيرًا}.
পুরুষ নারীদের অভিভাবক, যেহেতু আল্লাহ তাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু পুরুষগণ নিজেদের অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে। সুতরাং সাধ্বী স্ত্রীগণ অনুগত হয়ে থাকে, (পুরুষের)অনুপস্থিতিতে আল্লাহ প্রদত্ত হিফাজতে (তার অধিকারসমূহ) সংরক্ষণ করে। আর যে সকল স্ত্রীর ব্যাপারে তোমরা অবাধ্যতার আশংকা কর, (প্রথমে) তাদেরকে বুঝাও এবং (তাতে কাজ না হলে) তাদেরকে শয়ন শয্যায় একা ছেড়ে দাও এবং (তাতেও সংশোধন না হলে) তাদেরকে প্রহার করতে পার। অতঃপর তারা যদি তোমাদের আনুগত্য করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো (ব্যবস্থা গ্রহণের) পথ খুঁজো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকলের উপর, সকলের বড়।-সূরা নিসা (৪) : ৩৪
অতএব যথাসম্ভব দাম্পত্য জীবন টিকিয়ে রাখাতেই কল্যাণ। স্বামী-স্ত্রী যদি ধৈর্য ধরে সংসার টিকিয়ে রাখে, তবে আল্লাহ তাআলা ইনশাআল্লাহ তাদেরকে উত্তম বদলা দিবেন। তালাকের আলোচনা আসবে তখনই, যখন সমাধানের সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। সংসারটাকে টিকিয়ে রাখা অরণ্যে রোদন ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, তখনই তালাকের ব্যাপারে চিন্তা করা যেতে পারে। তার আগে নয়।
পাশাপাশি তালাক প্রদানেরও বিধিসম্মত নিয়ম আছে। সংসারটাকে টিকিয়ে রাখতে হলে সুন্দর করে টিকিয়ে রাখুন, ভাঙতে হলেও সুন্দরভাবে ভাঙুন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
{الطَّلَاقُ مَرَّتَانِ فَإِمْسَاكٌ بِمَعْرُوفٍ أَوْ تَسْرِيحٌ بِإِحْسَانٍ….}.
তালাক (বেশির বেশি) দুবার হওয়া চাই। অতঃপর (স্বামীর জন্য দুটি পথই খোলা আছে) : হয়ত নীতিসম্মতভাবে (স্ত্রীকে) রেখে দেবে (অর্থাৎ তালাক প্রত্যাহার করে নেবে), অথবা উৎকৃষ্ট পন্থায় তাকে ছেড়ে দেবে (অর্থাৎ প্রত্যাহার না করে বরং ইদ্দত শেষ করতে দেবে)।-সূরা বাকারা (২) : ২২৯
এজন্য তালাকের সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া প্রায় বাধ্যতামূলক পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন তালাক দিলেও সুন্দরভাবে সিস্টেম অনুযায়ী দেওয়া চাই। অন্যথায় তুচ্ছ সমস্যাকে কেন্দ্র করে তালাক দিলে বহু ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা আছে। অকারণে তালাক দিলে কী কী ক্ষতি হতে পারে, তা বর্ণনা করতে গিয়ে হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
১. নিজের নির্বুদ্ধিতা ও মূর্খতা প্রকাশ পায়।
২. বিয়ে, যা একটি মহান নিয়ামত, তার প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়।
৩. স্ত্রী এবং তার পরিবারের প্রতি অন্যায় ও কষ্ট দেওয়ার কারণ হয়।
৪. তালাকের কারণে স্ত্রী এবং সন্তানদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
৫. স্ত্রীকে লাঞ্ছিত করা হয়। অনেকেই তার চরিত্র খারাপ বলে অপবাদ তোলার সুযোগ পায়। অন্য কোথাও বিবাহ দিতে গেলেও তার সমস্যা সৃষ্টি হয়। ফলে তার পুরো জীবন কষ্টের জীবনে পরিণত হয়।-তুহফায়ে যাওজাইন, পৃ. ১২৯
এজন্য হুটহাট তালাক দিয়ে দেওয়া জুলুম, অন্যায়। হ্যাঁ প্রয়োজনের সময় তালাক দেওয়া ঠিক আছে। প্রয়োজনের সময়, যখন দাম্পত্য জীবন বহাল রাখা ক্ষতিকর ও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, তখন যাতে সুন্দরভাবে আলাদা হয়ে যাওয়া যায়; এজন্যই তালাকের বিধান রাখা হয়েছে।- হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ৫/১৪০; রহমাতুল্লাহিল ওয়াসিয়াহসহ, শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী।
তালাকের পদ্ধতি
তালাকের সর্বমোট তিনটি পদ্ধতি রয়েছে।
১. স্ত্রী যখন মাসিক থেকে পবিত্র থাকবে, এবং এই পবিত্র অবস্থায় তার সাথে স্বামী-স্ত্রীসূলভ বিশেষ আচরণ না করা হবে, তখন শুধুমাত্র এক তালাক দেওয়া। আর তালাক না দেওয়া। এভাবেই তার ইদ্দত (তালাকের পর নির্ধারিত কিছু দিন অতিক্রম করা অন্যত্র বিবাহ করার উপযুক্ত হওয়ার জন্য) অতিক্রম হয়ে যাবে। তালাকের এই পদ্ধতি সর্বোত্তম পদ্ধতি।
২. প্রত্যেক তুহরে (মাসিক থেকে পবিত্র অবস্থা) এক তালাক করে তিন তালাক দেওয়া। এটাও জায়েজ পদ্ধতি।
৩. এক মজলিসে অথবা এক কথায় তিন তালাক দিয়ে দেওয়া। এটা জুলুম, অন্যায় ও বিদআত।-মুখতাছারুল কুদুরী, পৃ. ৫৯৬
মাওলানা আবু রুফাইদা ইমরান
লেখক, গবেষক ও শিক্ষক
উস্তায, জামিয়া মাদানিয়া কাওমিয়া শেখ এম এ জব্বার কমপ্লেক্স, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, সিলেট, বাংলাদেশ।