২৯শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৫ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সোমবার , সকাল ৭:১৫

মুআমালাত – পর্ব- ১

মুআমালাত – পর্ব- ১

উপার্জনে হালাল হারাম : গুরুত্ব প্রয়োজনীয়তা

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মানুষকে বিভিন্ন চাহিদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টিগতভাবেই মানুষের বিভিন্ন চাহিদা থাকে। যেমন, খাদ্য, ঘুম, সুখ-শান্তি, যশ-খ্যাতি, আনন্দ, বিনোদন, ইত্যাদি। এসব চাহিদা বৈধ পন্থায় পূরণের জন্য ইসলামের রয়েছে পরিপূর্ণ নির্দেশনা ও গাইডলাইন।

উপার্জন মানুষের জীবনের তেমনই একটি মৌলিক চাহিদা। এই চাহিদা পূরণের জন্য শরীয়াহয় যে বিশদ গাইডলাইন রয়েছে তার শিরোনাম হালাল ও হারাম। উপার্জন হালাল হওয়া ও হারাম মুক্ত হওয়া ইসলামে নামায-রোযার মতো  ফরয বিধানসমূহের পর অন্যতম ফরয বিধান। তাই এ বিষয়ে জানা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য আবশ্যক। নিম্নে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে এ বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহের নির্দেশনা সংক্ষিপ্তভাবে পেশ করা হলো।

  • হালাল হারামের পরিচিতি
  • হালাল উপার্জনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

– আলকুরআনুল কারীম থেকে

– সহীহ হাদীস থেকে

– সালাফের জীবন থেকে

হালাল ও হারামের পরিচিতি

হালালের পরিচয় :

আল্লামা মুহাম্মদ আলী থানভী রহ. হালাল এর পরিচয় বলেছেন,

الحلال ما أباحه الكتاب والسنة بسبب جائز مباح.

বৈধ কোনো কারণের ভিত্তিতে কুরআন-সুন্নাহ যার অনুমোদন দিয়েছে সেটাই হালাল।-কাশশাফু ইসতিলাহিল ফুনূন ১/৭৫

অর্থাৎ হালাল হলো প্রত্যেক এমন বিষয়, শরীয়তে যার অনুমোদন আছে। অন্য ভাষায় বললে, যা শরীয়তে নিষিদ্ধ নয়।

হারামের পরিচয় :

ইমাম আবু বকর জাসসাস রহ. হারাম এর পরিচয় দিয়েছেন এভাবে,

المحظور ما يستحق بفعله العقاب وبتركه الثواب.

হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয় হলো, যা করার কারণে শাস্তির সম্মুখীন হতে হয় এবং ছেড়ে দেওয়ার দ্বারা সাওয়াব লাভ হয়। –আল-ফুসূল ফিল উসূল ২/৯৯

অর্থাৎ শরীয়াহ নিষিদ্ধ প্রত্যেক এমন বিষয়, যা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। একই সাথে তা বর্জন করার দ্বারা সাওয়াব অর্জন হয়।

হালাল উপার্জনের গুরুত্ব : কুরআন থেকে

আলকুরআনুল কারীমের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা হালাল উপার্জনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং এর ব্যাতিক্রম করলে ভয়াবহ শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন।

আল্লাহ তাআলার ক্রোধে নিপতিত হওয়া মারাত্মক শাস্তির ভয় : আলকুরআনুল কারীমে সূরা ত্বহার ৮১ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা হালাল উপার্জনের নির্দেশ দিয়ে এবং এর বিপরিত করলে আল্লাহ তাআলার ক্রোধে নিপতিত হওয়ার ভয়াবহ পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ইরশাদ করেন-

{كُلُوْا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَلَاتَطْغَوْا فِيْهِ فَيَحِلَّ عَلَيْكُمْ غَضَبِيْ وَمَنْ يَحْلِلْ عَلَيْهِ غَضَبِيْ فَقَدْ هَوَىٰ}.

‘তোমাদেরকে যা দান করেছি, তা থেকে ভালো ও হালাল বস্তু আহার করো এবং এই বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করো না। অন্যথায় তোমাদের ওপর আমার ক্রোধ অবধারিত হয়ে যাবে। আর যার ওপর আমার ক্রোধ আপতিত হয় সে ধ্বংস হয়ে যায়।’

হারাম উপার্জন শয়তানের অনুসরণ : এমনিভাবে সূরা বাকারার ১৬৮ নং আয়াতে হালাল এর বিপরিত পন্থাকে শয়তানের অনুসরণ আখ্যায়িত করে ইরশাদ করেন-

{يَۤا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوْا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا وَلَا تَتَّبِعُوْا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ، إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ}.

‘হে মানবজাতি, পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা থেকে তোমরা আহার করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’

অবৈধ উপার্জন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ : একইভাবে সব ধরনের হারাম ও অবৈধ উপার্জন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে সূরা নিসার ২৯ নং আয়াতে ইরশাদ করেছেন-

{يَۤاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَاتَأْكُلُوْا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِل}.

‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করো না।’

আল কুরআনুল কারীমের এই নিষেধাজ্ঞা অত্যন্ত ব্যাপক। “আল আকলু বিল বাতিল” এর সরল অর্থ হলো অন্যায়ভাবে সম্পদ ভোগ করা। অর্থাৎ শরীয়াহ নিষিদ্ধ পথে সম্পদ ব্যবহার করা। চাই তা অন্যের সম্পদ হোক কিংবা নিজের।

অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করার অর্থ : অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করার অর্থ হলো, চুরি, ডাকাতি, রিবা, খেয়ানত, জুয়া, ঘুষ, ইত্যাদি অবৈধ পন্থায় সম্পদ উপার্জন করা।

এছাড়াও এর মধ্যে আরো আছে, বিনিময়হীন ভোগ। যেমন, বাস ভাড়া না দিয়ে নেমে পড়া। শ্রমিকের বেতন না দেওয়া ইত্যাদি।

এর মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অন্যের অনুমোদন ছাড়া তার সম্পদ ব্যবহার করা। যেমন, সরকারী অফিসের ফোন ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা। বন্ধু বা সহকর্মীর জিনিসপত্র তার অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা। অর্থাৎ, এমন ব্যবহার যা সাধারণত অনুমোদনের মধ্যে পড়ে না।

আর্থিক লেনদেনের মাঝে আছে, ফাসেদ লেনদেন থেকে প্রাপ্ত মূল্য গ্রহণ করা। যেমন, কেউ ইচ্ছাকৃত নষ্ট কোনো পণ্য বা খাবার বিক্রয় করেছে। তাহলে বিক্রেতার জন্য এভাবে মূল্য গ্রহণ ও ব্যবহারও ‘আল আকলু বিল বাতিল’ এর অন্তর্ভুক্ত।

তদ্রূপ যেসব কাজ বৈধ নয়, সেসবের বিনিময় গ্রহণ করাও ‘আল আকলু বিল বাতিল’ এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন, গান গেয়ে, নাচ করে, ব্যভিচার করে বা এ ধরণের হারাম কাজ করে উপার্জন করা। এক্ষেত্রে যদি দাতার সম্মতি থাকে, তদুপরি সম্পদ উপার্জনের পথ যেহেতু নিষিদ্ধ, তাই প্রাপ্তিও নিষিদ্ধ।

সুতরাং ইসলামে শুধু রিবা বা সুদ-ই হারাম নয়; আল আকলু বিল বাতিল’ও হারাম। এ বিষয়ে আমাদের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে!

হালাল উপার্জনের গুরুত্ব : হাদীস থেকে

আলকুরআনের পাশাপাশি হাদীসে রাসূলেও হালাল উপার্জনের অতীব গুরুত্ব তুলে ধরে বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং হারাম থেকে বাঁচার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে। নিম্নে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হলো।

হালাল উপার্জন প্রত্যেক মুসলমানের উপর ওয়াজিব : হযরত আনাস বিন মালিক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

>طَلَبُ الْحَلَالِ وَاجِبٌ عَلى كُلِّ مُسْلِمٍ<.

হালাল রুজি সন্ধান করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ওয়াজিব।-আল-মু‘জামুল আওসাত, হাদীস ৮৬১০; হাদীসটির সনদ দূর্বল। তবে মূল বক্তব্যের অনেক শাহেদ (সমর্থন) রয়েছে।

জ্ঞাতব্য, উপার্জনের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। কখনো তা ফরয, কখনো মুস্তাহাব। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা পরবর্তী পর্বে করা হবে ইনশাআল্লাহ।

হারাম খাওয়ার চেয়ে মাটি খাওয়া উত্তম : হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

>وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ……. وَلَأَنْ يَأْخُذَ تُرَابًا فَيَجْعَلَهُ فِي فِيهِ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَجْعَلَ فِي فِيهِ مَا حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ<

সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের জন্য আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তা ভক্ষণ করার চেয়ে নিজের মুখে মাটি দেওয়া অনেক উত্তম।- মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৭৪৯০

হারাম উপার্জন দুআ কবুলের ক্ষেত্রে অন্তরায় : হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

>يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا، إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ}، وَقَالَ: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ}، ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ، يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ، يَا رَبِّ، يَا رَبِّ، وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ، وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ، وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ، فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ؟<.

‘হে লোকসকল, নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র ছাড়া কিছু গ্রহণ করেন না। আল্লাহ তাআলা রাসূলদেরকে যে বিষয়ের আদেশ দিয়েছেন, মুমিনদেরকেও সে বিষয়ে আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, হে রাসূল, পবিত্র বস্তু থেকে আহার করো এবং সৎকর্ম করো। নিশ্চয় আমি তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জ্ঞাত। -সূরা মুমিনুন (২৩) : ৫১ অন্যত্র বলেছেন, হে ঈমানদারগণ, আমি তোমাদেরকে যে উত্তম রিযিক দিয়েছি, তা থেকে আহার করো। -সূরা বাকারা (২) : ১৭২

এরপর নবীজি সা. এমন এক ব্যক্তির কথা আলোচনা করলেন, যে মরুভূমিতে দীর্ঘ সফর করেছে। চুলগুলো এলোমেলো, ধুলায় ধুসরিত। আকাশের দিকে দুই হাত তুলে দোয়া করছে, ‘হে আমার রব, হে আমার রব!’ অথচ তার খাদ্য হারাম। পানীয় হারাম। পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম। তার শরীর বেড়ে উঠেছে হারাম দ্বারা। অতএব, তার দোয়া কিভাবে কবুল করা হবে! -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০১৫

লক্ষ করুন, নবীজী আশ্চর্য প্রকাশ করেছেন, এমন ব্যক্তির দুআ কিভাবে কবুল হতে পারে যার আহার, পানীয়, পোশাক-পরিচ্ছদ সব কিছুই হারাম। যে বেড়েই উঠেছে হারাম দ্বারা, কিভাবে তার দুআ কবুল হবে?

আমাদেরও আশ্চর্য হওয়া উচিত। নবীজীর সেই অনুভূতি নিজেদের মাঝে জাগ্রত করা উচিত। আমরা বিপদে পড়ে আল্লাহকে ডাকি, এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বলি, আল্লাহ আমার কথা কেন শুনছেন না? অথচ আমাদের আয় রোজগারের প্রতি দৃষ্টি নেই। হালাল হারামের তোয়াক্কা নেই।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হারাম থেকে বাঁচার তাওফীক দান করুন।

হালাল হারামের প্রতি গুরুত্বারোপ : সালাফের জীবন থেকে

হালাল হারামের ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন থেকে নিয়ে উম্মতের সালাফগণ খুবই সতর্ক ছিলেন। নিজেদের উপার্জনে সামান্য হারামের সংস্পর্শও যেন না আসে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করতেন।

হযরত আবু বকর রা. এর ঘটনা : হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. এর ঘটনা। একবার তার গোলাম তার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসলো। তিনি খাবার খাওয়ার পর জানতে চাইলেন, এই খাবার কোথা থেকে এনেছো? গোলাম উত্তরে বলল, আমি জাহেলী যুগে এক ব্যক্তির ভাগ্য গণনা করে দিয়েছিলাম। আমি ভালো গণক ছিলাম না। মূলত তাকে ধোঁকা দিয়েছিলাম। আজকে তার সাথে দেখা হলে সে আমাকে ঐ গণনার প্রারিশ্রমিক হিসাবে এই খাবারগুলো দিয়েছে। হযরত আবু বকর রা. এ কথা শোনার সাথে সাথে গলায় হাত দিয়ে খাবারটুকু বমি করে ফেলে দেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৮৪২

সাহাবায়ে কেরাম হালাল হারামের ব্যাপারে এতটাই সতর্ক ছিলেন।

বিশর হাফী . এর বোনের ঘটনা : একবার বিখ্যাত আল্লাহওয়ালা বিশর হাফী রহ.-এর বোন ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ.-এর নিকট প্রশ্ন করলেন, রাতে আমরা আমাদের বাড়ির ছাদে বসে চরকায় সুতা কাটি। তখন আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে সরকারি প্রহরীদের বিশাল কাফেলা হাতে মশাল নিয়ে অতিক্রম করে। তাদের সেই মশালের আলো আমাদের পর্যন্ত চলে আসে। এ অবস্থায় সেই মশালের আলোয় আমাদের জন্য চরকায় সুতা কাটা কি বৈধ হবে?

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে? প্রশ্নকারিণী জবাবে বললেন, আমি বিশর হাফী রহ. এর বোন। এ কথা শোনে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. কান্না করলেন। আর বললেন,من بيتكم يخرج الورع الصادق، لا تغزل في شعاعها  তোমাদের মতো উঁচ্চ পর্যায়ের লোকদের ঘর থেকে এমন প্রকৃত ও সত্য তাকওয়া-ই প্রত্যাশিত। সুতরাং তুমি তাদের আলোতে সুতা কাটবে না। -রিসালাতুল মুসতারশিদীন, টীকা, শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ, পৃ. ৭৫

দেখুন, আর্থিক বিষয়ে সালাফ কত সতর্ক ছিলেন! সামান্য আলোতে সুতা কাটা যাবে কি না এমন প্রশ্নও তখন করা হতো! আর আজ আমাদের অবস্থা কী?

সর্বোচ্চ তাকওয়ার পরিচয় :

হালাল হারামের ব্যাপারে সালাফের বক্তব্য ছিল, أعلى الورع ترك الحلال مخافة الحرام  সর্বোচ্চ তাকওয়া হলো, হারামের ভয়ে কিছু হালালও ছেড়ে দেওয়া। -রিসালাতুল মুসতারশিদীন, টীকা, শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ, পৃ. ৭৫

অর্থাৎ হারাম থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজনে হালালও ছেড়ে দেওয়া হলো তাকওয়ার সর্বোচ্চ স্তর। তাই যে চাকরিতে, যে পেশায়, যে পরিবেশে হারামের আশংকা আছে, তাকওয়ার দাবি হলো তাতে অগ্রসর না হওয়া। যদিও তা আপাত দৃষ্টিতে হালাল হয়। যেমনটা হাদীসে এসেছে। হযরত নু‘মান ইবনে বাশির রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

>إِنَّ الْحَلَالَ بَيِّنٌ، وَإِنَّ الْحَرَامَ بَيِّنٌ، وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ لَا يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ، فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ، وَعِرْضِهِ، وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِي الْحَرَامِ<.

নিশ্চয় হালাল সুস্পষ্ট, হারাম সুস্পষ্ট। এই দুয়ের মধ্যখান হলো সংশয়পূর্ণ। যা অধিকাংশ মানুষ জানে না। যে ব্যক্তি সংশয়পূর্ণ বিষয় থেকে বেঁচে থাকলো সে নিজের দ্বীন ও সম্মানকে রক্ষা করলো, আর যে সংশয়পূর্ণ বিষয়ে আপতিত হলো সে হারামে জড়িয়ে গেলো। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৯

সালাফের নারীদের তাকওয়া : বিশর হাফী রহ. এর বোনের মতোই হালাল হারামের ব্যাপারে সালাফের নারীদের তাকওয়া ছিল প্রবাদতুল্য। ইমাম গাজালী রহ. তার অনবদ্য গ্রন্থ ‘ইহইয়াউ উলূমিদ্দিন এ লিখেছেন, সালাফের নারীদের স্বভাব ছিল, পুরুষ যখন উপার্জনের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হত, তখন স্ত্রী কন্যারা তাকে এই বলে বিদায় দিত, إِيَّاكَ وَكَسْبَ الْحَرَامِ فَإِنَّا ‌نَصْبِرُ ‌عَلَى ‌الْجُوْعِ وَالضَّرِّ وَلَا نَصْبِرُ عَلَى النَّارِ  হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থেকো, আমরা ক্ষুধা, কষ্ট সহ্য করতে পারবো। কিন্তু জাহান্নামের আগুন সহ্য করতে পারবো না। -ইহয়াউ উলূমিদ্দীন, ইমাম গাজালী ২/৫৮

এই ছিল সালাফের তাকওয়া এবং হালাল হারামের ব্যাপারে সতর্কতার চিত্র। সালাফের জীবনীতে এমন হাজারো গল্পের সন্ধান মেলে। যেখানে নারী তার স্বামীকে হারাম থেকে বাঁচতে সহযোগিতা করে, ছেলে মেয়ে তাদের পিতাকে সহযোগিতা করে, বোন তার ভাইকে সহযোগিতা করে। হালালের উপর থাকতে সকলে সচেষ্ট। হারাম থেকে বাঁচতে সকলে বদ্ধপরিকর। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে, আমাদের পরিবারকেও এমন বানিয়ে দিন।

হালাল হারামের ব্যাপারে সমসাময়িক দুইজন মনীষীর সারগর্ভ বাণী

শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. : আল্লামা শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. (১৩৩৬ হি.-১৪১৭ হি./১৯১৭-১৯৯৭ খ্রি.) ছিলেন নিকট অতীতের আরবের বিখ্যাত আলেম। তিনি একাধারে হাদীস বিশারদ, ফকিহ, আরবী ভাষাবিদ, মুহাক্কিক, ইসলামী চিন্তাবিদ, বস্তুনিষ্ঠ লেখক ছিলেন। হালাল ব্যবসা-বাণিজ্যে উদ্বুদ্ধ করণ বিষয়ক ইমাম ইবনে খাল্লাল রহ. (৩১১ হি.)-এর একটি গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বর্তমান সময়ে উপার্জনে হালাল-হারাম বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে একটি সারগর্ভ বক্তব্য পেশ করেছেন। বক্তব্যটির সারমর্ম নিম্নে পেশ করা হলো,

‘বর্তমানে প্রায় সকল মানুষ উপার্জনের কোনো না কোনো পন্থায় লেগে আছে। বরং সম্পদ উপার্জনকে এতো বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, যা আগে কখনো হয়নি। মানুষের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে আছে আর্থিক সমৃদ্ধি অর্জন। ফরয ও ওয়াজিব ইবাদতের ওপরও একে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। তাই এখন আর কাউকে উপার্জনে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করার তেমন প্রয়োজনীয়তা নেই।

এখন মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় হলো, তাদেরকে হারাম উপার্জন থেকে সতর্ক করা। এখন তো সুদ, ঘুষ, ছিনতাই, সিন্ডিকেট, মিথ্যা, প্রতারণা, যাকাত না দেওয়া ইত্যাদি সকল অন্যায় সমাজে ছেয়ে গেছে। যার কারণে মানুষের চরিত্র কলুষিত হচ্ছে। সমাজ থেকে ভ্রাতৃত্ববোধ উঠে যাচ্ছে। পরকালের ওপর ইহকালকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং মানুষকে এসব ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে সতর্ক করা এখন খুবই জরুরি।

যার উপার্জনে হারাম ঢুকে যায়, তার থেকে আল্লাহর আনুগত্য, ভালো কাজের আশা করা যায় না। কারণ, খারাপ কাজ সবসময় খারাপের দিকেই আহ্বান জানায়। বিশেষত যখন খাদ্য হারাম থাকে, তখন বিষয়টি আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। সুতরাং আমাদের মধ্যে থেকে কারো ব্যাপারে যদি দেখা যায়, তার চরিত্রে, চলনে সমস্যা আছে, আল্লাহর আনুগত্য করে না, পাপাচারে লিপ্ত, তাহলে তুমি তার উপার্জনের উৎস তালাশ করে দেখো, তাতে হারাম আছে। কারণ হারাম সম্পদ মানুষের চরিত্র কলুষিত করে, আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।’ -আল হাছছু আলাত তিজারাহ, মূল লেখক : ইমাম আবু বকর ইবনু খাল্লাল হাম্বলী রহ. (মৃত্যু :  ৩১১ হি.), টীকা লেখক, শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ., ভূমিকা দ্র. পৃ. ৭

শায়খুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী হাফি. : শায়খুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ। বর্তমান সময়ে মুসলিম বিশ্বের প্রথম সারির বিশ্বনন্দিত আলেম ও ইসলামী স্কলারদের অন্যতম। তিনি এক বয়ানে হালাল হারামের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে বলেছেন,

‘কেউ যদি সর্বদা এই ফিকির ও চিন্তা নিয়ে চলে যে, তার উপার্জনে যেন এক টাকাও হারাম না ঢুকে। তাহলে ইয়াকীন ও বিশ্বাস রাখুন, যদি ওই লোক জীবনে কোনো নফল নামাযও না পড়ে, নিয়মিত যিকির-তাসবীহও আদায় না করে, বরং নিজেকে হারাম উপার্জন থেকে রক্ষা করে কবর পর্যন্ত চলে যায়, তাহলে ইনশাআল্লাহ সে সোজা জান্নাতে যাবে। আর যদি এমন হয় যে, হালাল-হারামের কোনো ফিকির নেই। তবে তাহাজ্জুদ মিস হয় না। যিকির-তাসবীহ নিয়মিত হয়। তাহলে এসব নফল ইবাদত তাকে হারাম উপার্জনের আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবে না।’ -ইসলাহি খুতুবাত ১০/৭৪

হালাল হারাম; মানতে হলে জানতে হবে

উপরোক্ত আলোচনাগুলো নিশ্চয় আমাদের মনকে আন্দোলিত করেছে। সামান্য হলেও নাড়া দিয়ে গেছে। হয়তো নিজের অজান্তেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি, আমাকে হারাম থেকে বাঁচতে হবে, যদি সত্যিকার অর্থে সফল হতে চাই, যদি সুখময় জীবন চাই ইহকাল ও পরকালে।

কিন্তু কোনটা হালাল, কোনটা হারাম? কিভাবে বাঁচবো হারাম থেকে? কিভাবে মানবো হালাল ও হারামের বিধান? হ্যা, মানতে হলে জানতে হবে। জানতে হবে, কিভাবে হারাম ছড়িয়ে আছে আমাদের সমাজের প্রতিটি পরতে পরতে। আর কীইবা তা থেকে বাচাঁর উপায়।

এ সম্পর্কে জানাতেই কাজ করে যাচ্ছে আল হিকমাহ ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনের গবেষণা বিভাগ থেকে প্রকাশিত হালাল হারাম বিষয়ক পরবর্তী পর্বগুলোতে আমরা জানবো সবিস্তারে। আল্লাহ তাআলা ফাউন্ডেশনের সকল কাজকে কবুল করুন। ‍

 

লেখক : মুহাম্মদ সানাউল্লাহ

লেখক, গবেষক ও শিক্ষক

উস্তদ, মারকাযু দিরাসাতিল ইকতিসাদিল ইসলামী, বনশ্রী, ঢাকা।

#Leave A Comment

#Leave A Comment