২৯শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৫ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সোমবার , দুপুর ২:৩৫

ঈমান-আকীদা, পর্ব-১

ঈমান-আকীদা, পর্ব-১

ইসলামী আকীদা পরিচিতি

আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বান্দার ওপর প্রথম আদেশ হলো, তাঁর প্রতি ঈমান আনা এবং তাঁর রাসূলের আনীত দ্বীন কবুল করা। বস্তুত ঈমান-ই হলো, বান্দার আসল সম্পদ, দুনিয়া-আখেরাতের প্রকৃত কল্যাণ, চিরস্থায়ী জান্নাত-জাহান্নামের ফায়সালার ভিত্তি এবং মহান প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁর কাছে সম্মানিত হওয়ার প্রধানতম পথ ও পন্থা।

ঈমান অর্থে ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দ :

মুসলিমদের ধর্ম-বিশ্বাস বোঝাতে কুরআনুল কারীম ও হাদীস শরীফে শুধু ঈমান শব্দটির ব্যবহার এসেছে। তবে হিজরী দ্বিতীয় শতক থেকে ঈমান শব্দের পাশাপাশি আল-ফিকহুল আকবার, আস-সুন্নাহ, আশ-শরীয়াহ, উসূলুদ্দিয়ানাহ, আত-তাওহীদ, আল-আকীদাহ ইত্যাদি আরও কিছু পরিভাষা পরিচিতি লাভ করে। এগুলোর মধ্যে আকীদাহ পরিভাষাটি সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করে। পরবর্তী যুগে এটি একমাত্র পরিভাষায় পরিণত হয়।-দ্র. কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ঈমান-আকীদা, মাওলানা সাঈদ আহমাদ ১/১৯

বিভিন্ন জায়গায় এধরনের ক্ষেত্রে ইসলাম শব্দের ব্যবহারও দেখা যায়। মূলত ঈমান ও ইসলামের পরস্পর সম্পর্ককে তুলনা করা যায় মানুষের দেহ ও প্রাণের সম্পর্কের সাথে। ইসলাম যেন দেহ ও তার অঙ্গ-প্রতঙ্গ। আর ঈমান হলো, তার প্রাণ। দেহের বিভিন্ন অঙ্গ কর্তিত হলেও যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে, ততক্ষণ দেহের মূল্য আছে। কিন্তু প্রাণহীন দেহের কোন মূল্য নেই।

বিষয়টি আরেকভাবে বলা যায়, দ্বীন-ইসলামের দুটি ভাগ আছে। এক-ঈমান। দুই- আমল। ঈমান হলো, দ্বীনের বিশ্বাসগত দিক, যাকে সহীহ বুখারীর ৮ নং হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে তাওহীদ ও রিসালাতের শাহাদাতরূপে। আর আমল হলো, দ্বীনের ব্যবহারগত দিক, যাকে উক্ত হাদীসে সালাত, যাকাত, হজ্জ শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই বলা যায়, ঈমান ও ইসলাম হচ্ছে একই সত্যের দুটি দিকমাত্র। অর্থাৎ অন্তরের বিশ্বাস যেটি, সেটি হলো ঈমান। আর দেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গের আমল ও আচরণ হলো, ইসলাম। ভিতরের বিশ্বাস ও বাহিরের আমল উভয়টি মিলেই ঈমান পরিপূর্ণ হয়। তত্ত্বগতভাবে দুটি আলাদা হলেও বাস্তবে তা আলাদা নয়।

তবে ঈমান-আকীদা শব্দদ্বয়ের মাঝে এভাবে ব্যবাধান করা হয় যে, ঈমান হলো, মূল ও আসল, আকীদা-বিশ্বাস হলো, তার উপাদান। অর্থাৎ, আল্লাহ এক, নবী-রাসূল সত্য, আখেরাত সত্য ইত্যাদি আকীদা-বিশ্বাসের সমষ্টিতে ঈমান জন্মলাভ করে। এক্ষেত্রে আকীদা-বিশ্বাস পরিশুদ্ধ হলে ঈমান পরিদ্ধ হবে। কাজেই বিশুদ্ধ ঈমানের জন্য বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাস থাকতে হবে।

আকীদা বা ই‘তিকাদ এর শাব্দিক অর্থ হল, গিরা দেওয়া, চুক্তি করা, দৃঢ় করা, দৃঢ়ভাবে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, শক্ত হওয়া ইত্যাদি। আর ধর্ম-বিশ্বাস দ্বারা যেহেতু মানুষ তার ধর্মের সাথে সন্দেহমুক্ত ও দৃঢ় চুক্তি করে এবং শক্ত ও দৃঢ়ভাবে বন্ধন সৃষ্টি করে, তাই এটিকে আকীদা বলা হয়। প্রসিদ্ধ অবিধানবেত্তা আহমাদ ফাইউমী রহ. (৭৭০ হি.) লেখেন,

اعتقدت كذا : عقدت عليه القلب والضمير، حتى قيل : العقيدة ما يدين الإنسان به، وله عقيدة حسنة سالمة من الشك

অর্থাৎ, আমি এর উপর ও মন ও মননকে দৃঢ় করেছি। তাই বলা হয় : মানুষ ধর্ম হিসেবে যা গ্রহন করে, তাকে ‘আকীদা’ বলা হয়। (যেমন, আরবীতে বলা হয়,) তার সন্দেহমুক্ত ভালো আকীদা-বিশ্বাস রয়েছে। দ্রষ্টব্য, আল-মিসবাহুন নূরী ২/৪২১

উপরোক্ত পরিচয় থেকে বুঝা যায়, আকীদা নামে ভুষিত হওয়ার জন্য সকল আকীদা বিশুদ্ধ হওয়া আবশ্যক নয়। বিশুদ্ধ হলে বলা হবে সহীহ আকীদা। অশুদ্ধ হলে বলা হবে ভ্রান্ত আকীদা। শরহু জময়িল জাওয়ামিতে বর্ণিত হয়েছে,

الاعتقاد : هو الحكم الجازم القابل للتغير، طابق الواقع أو لم يطابقه، فإن طابق الواقع فهو اعتقاد صحيح، وإن لم يطابق الواقع فهو اعتقاد فاسد.

অর্থ : আকীদা হলো, ওই দৃঢ় সংকল্পের নাম, যা পরিবর্তন গ্রহন করে। বাস্তবতার সঙ্গে মিলুক বা না মিলুক। বাস্তবতার সঙ্গে মিল থাকলে বলা হবে, সহীহ আকীদা। আর বিপরীত হলে বলা হবে ভ্রান্ত আকীদা। -শরহু জাময়িল জাওয়ামি মাআ হাশিয়াতিল বান্নানী ১/১১০

পরিভাষায় আকীদা বলা হয়

العقيدة هو العلم الذي يبحث فيما يجب على الإنسان أن يعتقده ويؤمن به، ويقيم عليه البرهان الصحيح الذي يفيد اليقين. ويطلق أيضا على : المبادئ الدينية نفسها التي تثبت بالبرهان القاطع.

অর্থ : আকীদা হলো এমন একটি জ্ঞান, যাতে একজন ব্যক্তি কী বিশ্বাস করবে এবং কিসের উপর ঈমান আনবে তা নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং এর উপর নিশ্চিত জ্ঞানপ্রদানকারী সঠিক দলিল প্রতিষ্ঠিত থাকে।

এমনিভাবে অকাট্য দলিল-প্রমান দ্বারা সাব্যস্ত ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলোকেও আকীদা বলা হয়। –আল আকীদাতুল ইসলামিয়্যাহ ১/১৮

ইসলামি আকীদার উদ্দেশ্য, ইসলামী শরীয়তের মৌলিক বিধি-বিধানগুলোর ক্ষেত্রে ভুল-ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকা এবং উভয় জাহানে সফলতা অর্জন করা।

আকীদার বিষয়গুলোর শ্রেণীবিন্যাস :

ঈমান-আকীদার বিষয়গুলো সাধারনত তিন ধরনের।

১. মুমিন ও কাফেরের মাঝে পার্থক্যকারী আকীদা

ঈমান-আকীদার প্রথম ও প্রধানতম স্তর হলো, এমন কিছু আকীদা-বিশ্বাস, যা লালন করলে একজন ব্যক্তি ঈমান ও ইসলামের দৌলতে সৌভাগ্যমণ্ডিত হয়; এর বিপরীত হলে হতভাগা-অমুসলিম হিসেবে গণ্য হয়। পরিভাষায় এসকল আকীদাকে (أصول الإيمان) উসূলুল ঈমান বা উসূলু আহলিল কিবলা বলা হয়। এগুলো ইসলামের মৌলিক আকীদা, যা ইসলাম ও কুফরের মাঝে পার্থক্যকারী। যেমন : ঈমানের আরকান তথা আল্লাহ, নবী-রাসূল, ফেরেশতা, কিতাব, আখেরাত ও তাকদীর। এভাবে অকাট্যভাবে প্রমাণিত জরুরিয়াতে দ্বীন তথা দ্বীনের স্বতঃস্বিদ্ধ ও পরিচিত যত বিষয় আছে, সবই এ প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। যেমন : কুরআন ও হাদীসের প্রামাণ্যতা, খতমে নবুওয়াত তথা নবীজির শেষ নবী হওয়া, কিয়ামাতের পূর্বে ঈসা আলাইহিস সালামের অবতরণ, ইসরা তথা মক্কা থেকে বাইতুল মাকদিস পর্যন্ত নবীজির রাত্রিকালীন সফর, জিন-জাতীর অস্তিত্ব, ইত্যাদি। এমনিভাবে এই বিশ্বাস করা যে, ইসলামই একমাত্র ধর্ম ও তা জীবনের সব ক্ষেত্রে বিস্তৃত, আল্লাহ তাআলাই বিধানদাতা, নামাজ, যাকাত, পর্দা ও জিহাদ ফরজ আর সুদ, মদ, যিনা ও প্রাণী/মানবভাস্কর্য হারাম হওয়া ইত্যাদি। ঈমান-আকীদার এ প্রকারের কোনো কিছু জেনে-বুঝে অস্বীকার করলে ইসলাম থেকে বের হয়ে কাফের হয়ে যাবে।

২. আহলুস সুন্নাহ ওয়ালা জামাআহ ও আহলুল বিদআহ বা বিপআতপন্থীদের মাঝে পার্থক্যকারী আকীদা

ইসলামে এমন কিছু আকীদা-বিশ্বাস আছে, যা বিশ্বাস করা-না করার ওপর মুমিন হওয়া-না হওয়া নির্ভর করে না। তবে ব্যক্তি মুমিন হওয়ার পর তার আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর অন্তর্ভুক্ত হওয়া-না হওয়ার বিষয়টা এর নির্ভর করে। এ-জাতীয় আকীদাকে পরিভাষায় (أصول أهل السنة) উসূলু আহলিস সুন্নাহ বলা হয়। যেমন : নবীগণ কবরে জীবিত, কবরে মুনকার-নাকীর দুই ফেরেশতার প্রশ্ন এবং সদকাতুল ফিতর (তথা ফিতরা) ইসলামের বিধান এই বিশ্বাস রাখা।

এই ধরনের বিষয়কেও অস্বীকার করা যাবে না। বরং এ-জাতীয় বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর বিপরীত বিশ্বাস কেউ রাখলে সে ফাসেক ও গোমরাহ বলে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ সে বেদআতপন্থীদের মধ্যে গণ্য হয়ে পথভ্রষ্ট ও গোনাহগার এবং বাহাত্তর দলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে জাহান্নামী হবে। —দ্রষ্টব্য, তাইসীরুত তাহরীর, আমীর বাদশাহ (৯৭২হি.) ৪/১৯৫-৯৭; রওযাতুত তালেবীন, ইমাম নববী (৬৭৬হি.) ১০/৬৪; শরহুল মাওয়াকিফ, সাইয়্যিদ মীর শরীফ জুরজানী (৮১৬হি.) ৮/৪০০

বি. দ্র. আকীদা-বিশ্বাসের কিছু বিষয় এমন, যা উল্লিখিত দুই প্রকারের কোন প্রকারের অন্তর্ভুক্ত — তা নিয়ে ইমামদের মাঝে মতভেদ আছে। এ ক্ষেত্রে সতর্কতার দাবি হলো, এটিকে প্রথম প্রকারে গণ্য করা। যাতে কুফুর থেকে সম্পূর্ণরূপে বাঁচা যায় এবং কারও মত অনুযায়ী কুফরে পড়তে না হয়। যেমন : মোজার উপর মাসেহের বৈধতা।

৩. এমন কিছু শাখাগত আকীদা, যাতে পরস্পরবিরোধী দলীল রয়েছে এবং সাহাবায়ে কেরামসহ পরবর্তী ইমামদের মাঝে ইখতিলাফ ও মতপার্থক্য রয়েছে।

যেমন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেরাজে আল্লাহ তাআলাকে দেখেছেন কি না এবং মৃত ব্যক্তি কবরে শ্রবন করে কি না ইত্যাদি।

এ ধরনের আকীদার ক্ষেত্রে কোনো পক্ষকে কাফের তো দূরের কথা, বিদআতপন্থী বা পথভ্রষ্টদের মধ্যেও গণ্য করা যাবে না। এমনকি গোনাহগারও বলা যাবে না। কারণ, এতে কোন পক্ষ সঠিক আর কোন পক্ষ বেঠিক, তা সুনিশ্চিত করে বলা যায় না। বরং এগুলো মাযহাবের শাখাগত মাসআলার মতো ইজতিহাতী বিষয়। যাতে ভুল হলেও ক্ষমা পাবে এবং একটি প্রতিদান পাবে। আর সঠিক হলে তো দ্বিগুণ প্রতিদান আছেই। -মাজমূউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়া (৭২৮হি.) ১২/৪৯২, ৪৯৪, ২৪/১৭২; মাজমূআতুর রাসায়িল ওয়াল মাসায়িল ৩/৩৪৭; সিয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবী (৭৪৮ হি.) ১০/১১৪ (ইমাম বুখারীর জীবনী), সহীহ বুখারী (৭৩৫২), সহীহ মুসলীম (১৭১৬/১৫)

ঈমানআকীদা সাব্যস্ত হওয়ার উৎস বা দলিল

আকীদার উৎস বা দলিল তিনটি বিষয় : কুরআনুল কারীম, সহীহ ও আমলযোগ্য হাদীস ও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর ইজমা।

ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ. (৪৬৩ হি.) বলেন—

>لَيْسَ فِي الِاعْتِقَادِ كُلِّهِ فِي صِفَاتِ اللَّهِ وَأَسْمَائِهِ إِلَّا مَا جَاءَ مَنْصُوْصًا فِيْ كِتَابِ اللَّهِ أَوْ صَحَّ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَوْ أَجْمَعَتْ عَلَيْهِ الْأُمَّةُ…..<.

আল্লাহ তাআলার সিফাত ও নামসহ সকল আকীদার উৎস হচ্ছে, কুরআন, সহীহ হাদীস  এবং উম্মাহর ইজমা। -জামিউ বয়ানিল ইলমি ওয়া ফাদলিহী ২/৯৪২ (দারু ইবনিল জাওযী)

ইসলামী আকীদার গুরুত্ব প্রয়োজনীয়তা 

আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বান্দার ওপর প্রথম ফরজ ও প্রধান হক হলো, ঈমান-আকীদা পরিশুদ্ধ করা। তাই ইসলামের প্রথম ও প্রধান ভিত্তি হলো, ঈমান-আকীদা। এর উপর নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাতসহ শরীয়তের সকল আমলের গ্রহনযোগ্যতা এবং প্রতিদান পাওয়ার আশা-আকাঙ্ক্ষা নির্ভর করে। বিশাল দালান দাঁড়ানোর জন্য যেমন ফাউন্ডেশন আবশ্যক, তেমনই নেক আমল কবুল হওয়ার জন্য বিশুদ্ধ ঈমান-আকীদা অত্যাবশ্যক।

ঈমান-আকীদার দৃষ্টান্ত ১, ২ সংখ্যার মতো, আর আমল হল শূন্যের মত। যদি ১, ২ সংখ্যা ছাড়া হাজারো শূন্য লেখা হয়, তাহলে দুনিয়াতে যেমন এর কোনো মূল্য নেই, ঠিক তেমনি সঠিক ও বিশুদ্ধ ঈমান-আকীদা পোষণ না করে যদি হাজারো আমল করা হয়, তাহলে আখেরাতে এর কোনো মূল্য নেই।

এ জন্য বিভিন্ন আয়াতে কারীমায় আল্লাহ তাআলা আমলের গ্রহনযোগ্যতা ও প্রতিদান পাওয়ার জন্য বিশুদ্ধ ঈমান-আকীদাকে পূর্বশর্ত বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে,

{مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ}.

অর্থ : পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ নেক আমল করবে, যদি সে ঈমানদার হয়, তাহলে আমি অবশ্যই তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের উৎকৃষ্ট কর্ম অনুযায়ী অবশ্যই প্রতিদান প্রদান করব। -সূরা নাহল (১৬) : ৯৭। আরও দ্রষ্টব্য, সূরা নিসা (৪) : ১২৪

এ আয়াতসহ আরও অনেক আয়াত থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, নেক আমলের পূর্বশর্ত হলো বিশুদ্ধ ঈমান-আকীদা। তাই নিম্নোক্ত হাদীসেও সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে, নামাজ ইত্যাদি আমলের পূর্বে প্রথম ও প্রধান কাজ হলো, ঈমান আনা ও আকীদা বিশুদ্ধ করা।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমা বলেন,

أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَعَثَ مُعَاذًا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ إِلَى اليَمَنِ، فَقَالَ: >ادْعُهُمْ إِلَى شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَأَنِّيْ رَسُولُ اللَّهِ، فَإِنْ هُمْ أَطَاعُوْا لِذَلِكَ، فَأَعْلِمْهُمْ أَنَّ اللَّهَ قَدِ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِي كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ ……<، وفي رواية: >إِنَّكَ تَقْدَمُ عَلَى قَوْمٍ مِنْ أَهْلِ الكِتَابِ، فَلْيَكُنْ أَوَّلَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَى أَنْ يُوَحِّدُوا اللَّهَ تَعَالَى<.

অর্থ : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুআয বিন জাবাল রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে ইয়মান অভিমুখে (শাসকরূপে) প্রেরণকালে বলেন, সেখানে অধিবাসীদের ‘আল্লাহ ব্যতিত কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল’ একথার সাক্ষ্যাদানের দাওয়াত দিবে। যদি তারা এ কথা মেনে নেয়, তাদের জানিয়ে দিবে যে, আল্লাহ তাআলা তাদের ওপর দিন ও রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৯৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯

আরেক বর্ণনায় এসেছে, তুমি (মুআয রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) আহলে কিতাবদের একটি কওমের কাছে চলেছো। অতএব তাদের প্রতি তোমার প্রথম দাওয়াত হবে, তারা যেন তাওহীদ বা আল্লাহর একাত্ববাদকে স্বীকার করে নেয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৩৭২

এ কারনে সাহাবাযে কেরাম রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুম সবকিছুর আগে ঈমান-আকীদা শিখেছেন। হযররত জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন,

>كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَنَحْنُ فِتْيَانٌ حَزَاوِرَةٌ، فَتَعَلَّمْنَا الْإِيمَانَ قَبْلَ أَنْ نَتَعَلَّمَ الْقُرْآنَ، ثُمَّ تَعَلَّمْنَا الْقُرْآنَ فَازْدَدْنَا بِهِ إِيمَانًا<.

অর্থ : আমরা কিশোররা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে থেকে কুরআনুল কারীম শেখার আগে ঈমান-আকীদা শিখেছি। অতঃপর কুরআন (অর্থসহ) শিখেছি। তখন আমাদের ঈমান-আকীদা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৬১। হাদীসটির সনদ সহীহ।

ইমাম তবারানী ও ইমাম বাইহাকী রহ. এর বর্ণনায় একই সনদে উক্ত হাদীসের শেষাংশে এসেছে,

>وَإِنَّكُمُ الْيَوْمَ تَعَلَّمُوْنَ الْقُرْآنَ قَبْلَ الْإِيمَانِ<.

অর্থ : আজ তোমরা ঈমান-আকীদা শেখার আগে কুরআনুল কারমি শিখছ। —আল-মুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস  ১৬৭৮; শুআবুল ঈমান, বাইহাকী,  হাদীস ৫০

দ্বীন ইসলামে মূল ও আসল হলো, আকীদা। সকল নবী-রাসূল আকীদার দাওয়াত দিতেন, যা তাঁরা ওহীর মাধ্যমে লাভ করেছিলন। সকল নবী-রাসূলদের সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক তাগিদ ছিল আকীদা বিশুদ্ধ করার ব্যাপারে। কুরআনুল কারীম নবীগণের দাওয়াতের যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা থেকে এ বিষয়টি একদম স্পষ্ট যে, তাঁদের দাওয়াতের সূচনাই হয়েছিল আকীদার মাধ্যমে।

পরিশুদ্ধ আকীদা ছাড়া সবই মূল্যহীন। কুরআনুল কারীম স্পষ্ট ভাষায় বলেছে,

{قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِيْنَ أَعْمَالًا، الَّذِيْنَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُوْنَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُوْنَ صُنْعًا، أُولَئِكَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ وَلِقَائِهِ فَحَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَلَا نُقِيْمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَزْنًا}.

অর্থ : বলুন, আমি কি তোমাদের অবহিত করব কাদের কৃতকর্ম বেশি নিষ্ফল ? যাদের চেষ্টা পার্থিব জীবনে হয় বিভ্রান্ত অথচ তারা মনে করে যে, তারা খুব ভালো কাজ করছে। তারাই সেই লোক, যারা তাদের রবের নিদর্শনাবলী ও তাঁর সাক্ষাৎকে অবিশ্বাস করে। সুতরাং তাদের কৃতকর্ম পণ্ড হয়ে গেছে। কাজেই কিয়ামতের দিন তাদের জন্য কোন ওযনের ব্যবস্থা করব না। – সূরা কাহাফ (১৮) : ১০৩-১০৫

বিশুদ্ধ ঈমান-আকীদা সর্বোত্তম আমল। হযরত আবু হুরায়রা রা.. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন আমলটি উত্তম ? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনা। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৬

যেকোনো আকীদা-বিশ্বাস এমন প্রভাব রাখে যে, যদি তা অন্তরে ভালোভাবে বসে যায়, তাহলে আমলে ও কাজকর্মে এর প্রতিফলন ঘটে। জন্ম নেয় আইন-কানুন, নীতি নৈতিকতা মেনে চলার অনুভতি। তাই আকীদা-বিশ্বাস ইসলামের সকল আইন-কানুন ও নীতিমালা বাস্তবায়িত হওয়ার এক অন্যতম চালিকাশক্তি। ইসলাম হালাল-হারামের যে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে নয়, বরং ঈমান ও আকীদার বিশুদ্ধ করা এবং আখেরাতে আল্লাহর সামনে উপস্থিতির অনুভুতি জাগ্রত রাখার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে।

আকীদা শত্রুতা ও মিত্রতার মাপকাঠি। সূরা কাফিরূন এর গুরুত্ব প্রমাণের জন্য সবচেয়ে বড় দলীল। এই সূরা মক্কা মুকাররমায় এমন এক সময় অবতীর্ণ হয়, যখন সময়ের দাবী ছিল, আকীদা ও ইবাদতের ব্যাপারে শত্রুতা সৃষ্টি না করা। বরং বিষয়টিকে ইসলাম শক্তিশালী হওয়া ও নিরাপদ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখা। কিন্তু কুরআনুল কারীম স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে,

{قُلْ يَاأَيُّهَا الْكَافِرُوْنَ، لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُوْنَ، وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُوْنَ مَا أَعْبُدُ، وَلَا أَنَا عَابِدٌ مَا عَبَدْتُمْ، وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُوْنَ مَا أَعْبُدُ} .

অর্থ : বলুন, হে কাফেরগণ! না আমি তোমাদের উপাস্যদের ইবাদত করি, আর না তোমরা আমার মাবুদের ইবাদত করো। আর না (ভাবিষ্যতেও) আমি তোমাদের উপাস্যদের ইবাদত করব, আর না তোমরা আমার মাবুদের উপাসনা করবে। —সূরা কাফিরূন (১০৯) : ১-৫, দস্তুরে হায়াত, পৃষ্ঠা ২৪, কুরআন সুন্নাহের আলোকে ঈমান-আকীদা, ১ম খণ্ডের ভূমিকা।

ইসলাম আকীদার ক্ষেত্রে কঠিন ও দৃঢ়পদ থাকার আদেশ করেছে। এতে কোনো ধরনের শিথিলতা বা আপসমূলক মনোভাবকে অবৈধ সাব্যস্ত করেছে। মুফাক্কিরে ইসলাম হজরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.— এর ভাষায়, ‘ঈমান ও আকীদার ব্যাপারে এই দৃঢ়তা ও অনমনীয়তাই হলো সেই সুস্পষ্ট বিভাজন রেখা, যা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের দাওয়াত আর শক্তিমান নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক লিডার, বিপ্লবী এবং ওই সব ব্যক্তিবর্গের মাঝে টেনে দেওয়া হয়েছে, যাদের চিন্তা-ভাবনার মূল উৎস নবীগণের শিক্ষা, নির্দেশনা, এবং পবিত্র সীরাতের স্থানে অন্য কিছু। -দস্তূরে হায়াত, ২১-২২; নির্বাচিত প্রবন্ধ ১/১৮-১৯

পরিশিষ্টে ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের কিছু বৈশিষ্ট্য এবং ব্যক্তি ও সমাজ পরিবর্তনে এর প্রভাব-প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু কথা উল্লেখ করে আলোচনার ইতি টানাটা উপকারী মনে করছি।

ইসলামী আকীদার কিছু বৈশিষ্ট্য :

১. ইসলামী আকীদাগুলো খুবই ষ্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীন এবং সরল-সহজ।

২. সুস্থ চিন্তা-চেতনার সাথে সামঞ্জস্যশীল।

৩. মুমিনকে সম্মানিত ও আত্মমর্যাদাশীল করে।

৪. মানবজাতি ও সৃষ্টিজগতের মাঝে সম্পর্ক গড়ে তোলে।

৫. মানবজাতির মধ্যে তার সৃষ্টিগত রসদ যোগায়।

৬. স্বল্পমেয়াদি ভোগ সমাগ্রীর বিপরীতে স্থায়ী, সুখী জীবন যাত্রার জানান দেয়।

৭. পূর্ববর্তী নবীগণের রিসালাতের বার্তার সাথে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্যশীলতার জানান দেয়।

 

সমাজ ব্যক্তি পরিবর্তনে ইসলামী আকীদার প্রভাবপ্রতিক্রিয়া।

১. মানবজাতি, সৃষ্টিজগত ও জীবন সম্পর্কে সঠিক চিন্তা-চেতনা প্রদান করে।

২. ভ্রান্ত ধ্যান-ধারনা ও সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করে।

৩. মানবতার আত্মিক চাহিদার রসদ জোগায়।

৪. মানুষের মাঝে দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলে।

৫. মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে রক্ষা করে।

৬. সৌভাগ্যের রাস্তা খুলে দেয়।

৭. সত্যের সামনে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মন-মানসিকতা সৃষ্টি করে। -আল-আকীদাতুল ইসলামিয়া পৃ. ৫৮৯-৬০৪

 

মুহাঃ শামীম আহমাদ

লেখক, গবেষক, শিক্ষক

উস্তাদ, জামিয়া ইসলামিয়া উত্তর কাফরুল, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, ঢাকা, বাংলাদেশ।

#Leave A Comment

#Leave A Comment