পরিবারনীতি – পর্ব-২
ফুলে ফুলে সাজানো সংসার
স্বামীর অধিকার,
স্ত্রীর অধিকার,
নবীজির সংসার: অনন্য সোনালী সংসার
আমি কবুল করলাম” বলার সাথে সাথে যার সাথে কোনোদিন দেখা সাক্ষাৎ হয়নি, সে হয়ে গেল প্রাণের প্রিয়! তার সুখে এখন আপনিও সুখী হবেন। তার কষ্টে আপনিও কষ্ট পাবেন। এই অপরূপ সম্পর্কের কারিগর তো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন! স্বামী-স্ত্রীর এই মধুর সম্পর্ক তো তাঁর অন্যতম নিদর্শন।
এবার আমাদের চিন্তা করতে হবে এই নূতন বর-কনের মাঝে নব্যসৃষ্ট মধুর বাঁধনকে কীভাবে মজবুত করা যায়। ফিকির করতে হবে, সামনের দিনগুলোতে আহুত নানা চড়াই উৎরাই কীভাবে তারা সহজে মোকাবিলা করতে পারে। খুঁজে দেখতে হবে, তাদের এই সুধা মিশ্রিত রিশতাকে ভালোবাসা আর মমতা দিয়ে ফুলে ফুলে কীভাবে সাজানো যায়।
দু’জন দু’জনার এই ছোট্ট সংসারে উভয়েরই কিছু দায়িত্ব ও অধিকার আছে। প্রত্যেকেই যদি নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে সম্পাদন করে, অন্যের অধিকার যথাযথভাবে পালন করে, তবেই সংসারে শান্তি ও স্থিতি আসবে। অন্যথায় সংসারে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি হবে। এজন্য এবার আমরা স্বামী-স্ত্রীর অধিকার নিয়ে কিছু আলোকপাত করবো ইনশাআল্লাহ।
স্বামীর অধিকার
১. সবক্ষেত্রে স্বামীর কথা মেনে চলা। তবে পাপ কাজে স্বামীর কথা মানা যাবে না।
২. তার সামর্থ্যের চেয়ে অধিক খোরপোষ না চাওয়া।
৩. নিজ ঘরে স্বামীর অনুমতি ছাড়া কাউকে প্রবেশের সুযোগ না দেওয়া।
৪. স্বামীর অনুমতি ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়া।
৫. স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার কোনো কিছু কাউকে না দেওয়া।
৬. স্বামীর অনুমতি ছাড়া নফল নামাজ, নফল রোজা না রাখা।
৭. কোনো শরয়ী প্রতিবন্ধকতা ছাড়া স্বামীর বিশেষ আহ্বানে সাড়া দিতে বিলম্ব না করা।
৮. দারিদ্র্যের কারণে অথবা চেহারা সুন্দর না হওয়ার কারণে স্বামীকে তুচ্ছজ্ঞান না করা।
৯. স্বামীকে নাম ধরে না ডাকা।
১০. স্বামী যদি শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক এমন কিছু করে, তবে আদবের সাথে তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করা।
১১. তার সাথে জবানদরাজি না করা।
১২. কারো সামনে স্বামীর দোষচর্চা না করা।
১৩. তার আত্মীয়দের সাথে বিবাদে লিপ্ত না হওয়া।
স্ত্রীর অধিকার
১. স্ত্রীর সাথে উত্তম আচরণ করা।
২. স্ত্রী অসমীচীন কিছু বললে ধৈর্য ধরা। তবে এক্ষেত্রে ভারসাম্য করা উচিত। অসমীচীন কথা-কাজ মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেলে তাকে সতর্ক করা।
৩. সাধ্যমতো খোরপোষ দেওয়া। এক্ষেত্রে অপব্যয় এবং কৃপণতা পরিহার করা।
৪. আত্মসম্মানবোধে ভারসাম্য রক্ষা করা। অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে স্বভাবের না হওয়া। আবারও পরিবারের ব্যাপারে একেবারে অমনোযোগী না হওয়া।
৫. হায়েজ-নেফাস ইত্যাদি নারীদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিধানাবলী ভালো করে শিখে স্ত্রীকে শেখানো এবং তাকে অন্যান্য ধর্মীয় বিধান পালনে উদ্বুদ্ধ করা।
৬. একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের প্রাপ্য অধিকার আদায়ে সমতা রক্ষা করা।
৭. প্রয়োজন মতো তার সাথে একান্তে সময় কাটানো। স্মার্টফোনে বুঁদ হয়ে না থাকা।
৮. স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া বিশেষ সময়ে আযল (স্ত্রীর যৌনাঙ্গের বাইরে বীর্যপাত করা) না করা।
৯. অপ্রয়োজনে তালাক না দেওয়া।
১০. সাধ্যমতো তার বসবাসের ব্যবস্থা করা।
১১. মাঝে মাঝে তার নিকটাত্মীয়দের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া।
১২. তার সাথে কাটানো বিশেষ মুহূর্তের কথা প্রচার না করা।-মিসালী ইজদিওয়াজী যিন্দেগী কে শরয়ী আহকাম, পৃ. ৫১-৫২ মাওলানা মুহাম্মাদ ইকবাল কুরাইশী হাফি.
১৩. তার সতীত্বের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। পরপুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে তাকে হেফাজত করা। তাকে পর্দায় রাখা।
নবিজির সংসার: অনন্য সোনালী সংসার
মুমিনদের জীবনে একমাত্র আদর্শ রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর জীবনের সবকিছুই সব নারী-পুরুষ সবার জন্য আদর্শ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একজন মুমিনের দায়িত্ব হলো, নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদর্শ মানা। তাঁর নীতি অনুসারে জীবন পরিচালনা করা। জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের পাশাপাশি নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাম্পত্য জীবন আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের সাথে দাম্পত্য জীবন যেভাবে কাটিয়েছেন, তা জেনে আমাদের দাম্পত্য জীবনকেও সেভাবে সাজানো আমাদের দায়িত্ব। এজন্য বিবাহ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাম্পত্য জীবন নিয়ে আলোচনা করা অপরিহার্য। কিন্তু নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাম্পত্য জীবন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই আমরা এ পর্বে নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সোনালী দাম্পত্য জীবন নিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে কিছু আলাপ করবো ইনশাআল্লাহ।
১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলিইহি ওয়াসাল্লাম, একজন উত্তম স্বামী
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বামী হিসেবে কেমন ছিলেন, তাঁর জবানিতেই জেনে নেওয়া যাক। নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
>خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لِأَهْلِي<.
তোমাদের মধ্যে উত্তম হল সে, যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। আর আমি আমার পরিবারের কাছে উত্তম ।-জামে তিরমিজী, হাদীস ৩৮৯৫; ইমাম তিরমিজী রহি. বলেছেন, হাদীসটি হাসান সহীহ
২. আম্মাজান খাদিজার জবানে নবিজীর প্রশংসা
দীর্ঘ চব্বিশটি বছর নবিজি কাটিয়েছেন খাদিজার সাথে। দাম্পত্য জীবনের সবচেয়ে লম্বা সময়টা নবিজি তাঁর সাথেই কাটিয়েছেন। খাদিজা যতদিন জীবিত ছিলেন, নবিজি আর কোনো বিবাহ করেননি। নবিজির সন্তান ইবরাহীম ছাড়া বাকি সব সন্তানের জন্ম খাদিজার ঘরে। এছাড়া আর কোনো স্ত্রীর ঘরে নবিজির সন্তান হয়নি। নবিজি খাদিজাকে খুব ভালোবাসতেন। খাদিজাও নবিজিকে ভালোবাসতেন আস্থা,বিশ্বাস ও সম্মানের সাথে।
নবিজি সর্বপ্রথম যখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহীপ্রাপ্ত হন, ওহী এবং নবুওয়েতর দায়িত্বের ভার আর জিবরাইলের চাপে নবিজি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। নিজের প্রাণ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন! তখন খাদিজা তাঁর পাশে দাঁড়ান। অভয় দেন। তাঁকে শান্ত করেন। দৃপ্তকণ্ঠে বলে ওঠেন, এটা কখনোই সম্ভব নয়, আল্লাহ তাআলা কখনোই আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। (আপনি কেন লাঞ্ছিত হবেন বরং আপনি সম্মানিত হবেন নিশ্চিত) কারণ, আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন। অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন। নিঃস্বকে সাহায্য করেন। মেহমানের মেহমানদারী করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন।-সহীহ বুখারী, হাদীস ৩
নবিজি খাদিজার কাছে কত মহান আর অনন্য ছিলেন, তাঁর উপরিউক্ত বক্তব্য থেকেই তা প্রতীয়মান হয়। নবিজিকে অভয় দিতে খাদিজার যে নীতি, তা সত্যিই অনন্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের নবিজকে যেমন অসাধারণ বানিয়েছেন, ঠিক তেমনই তার জীবনসঙ্গী হিসেবে অসাধারণ নারীকেই নির্বাচন করেছেন।
৩. তাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন নবিজি
নবিজির সব বিবিগণ উম্মতের মাতা। তাঁরা হলেন নারীজাতির আদর্শ। তাঁরা সাধারণ নারীদের মতো নন। তাঁরা প্রত্যেকেই সর্বোত্তম রাসূলের জীবনসঙ্গী। তাঁদের আমল-আখলাক, চিন্তা-চেতনা হবে উন্নত। তাঁদের ফিকির থাকবে কেবল আখেরাত নিয়ে। দুনিয়া তাঁদের কাছে নিতান্তই তুচ্ছ বলে বিবেচিত হবে। নবিজির পরিবারে মাসের পর মাস চুলায় লাকড়ি জ্বলে না। নবিজি সবর করেন। তাঁরাও নবিজির সাথে সবর করবেন। সম্পদ হাতে আসলে নবিজি সাথে সাথে দান করে দেন। তাঁরাও এমনই হবেন। নবীর স্ত্রীদের নীতি-নৈতিকতা এমন হওয়াই উচিত।
তবুও মানবিক দুর্বলতার কারণে তাদের কাছ থেকে কখনো অনুচিত কাজ হয়ে যেতে পারে, খুবই স্বাভাবিক। পরক্ষণে তাঁদেরকে সতর্ক করে দিলে তাঁরা সতর্ক হয়ে যাবেন, এটাও স্বাভাবিক নীতি। এমনই ঘটনা ঘটেছিল একবার। খন্দকের যুদ্ধের পরের ঘটনা। এর আগে মুসলমানদের দিন খুব কষ্টে কাটছিল। যুদ্ধে প্রচুর গনিমতের মাল অর্জিত হলো। মুসলমানদের চেহারায় আনন্দের চিহ্ন ফুটে ওঠলো। নবীপত্নীগণও এতে খুশি হলেন। তাঁরা মনে মনে ভাবলেন, এতোদিন অর্থকষ্টের কারণে কোনোমতে আমাদের জীবন চলেছে। মনমতো খোরপোষ ভাগ্যে জুটেনি। এবার হয়তো আমাদের কপাল খুলবে। মনমতো খোরপোষ হয়তো এবার পাওয়া যাবে। এমন চিন্তা করে তাঁরা নবিজির কাছে আবেদন করেন। তাঁদের খোরপোষ যেন আগের চেয়ে বাড়িয়ে দেওয়া হয়, নবিজির কাছে তাঁরা দরখাস্ত পেশ করেন। এমনকি রোম-পারস্যের রাণীদের জাঁকজমকপূর্ণ জীবনের উদাহরণও টেনে আনেন!
মানবিক দুর্বলতার কারণে তাঁদের এমন আবেদন অযৌক্তিক ছিল না, ঠিক আছে। তবুও, তাঁরা তো সর্বোত্তম নবীর স্ত্রী। তাঁরা তো সাধারণ নারীদের মতো নন। সাধারণ নারীদের মতো তাঁদের চিন্তা থাকা উচিত না। ফলে তাঁদের এমন আবদারের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা কোরআনের আয়াত নাজিল করেন। তাঁদেরকে দুনিয়ামুখী চিন্তা পরিহার করে আখেরাতমুখী চিন্তা লালনের জন্য সতর্ক করে নির্দেশনা প্রদান করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
{يَاأَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ إِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا فَتَعَالَيْنَ أُمَتِّعْكُنَّ وَأُسَرِّحْكُنَّ سَرَاحًا جَمِيلًا، وَإِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالدَّارَ الْآخِرَةَ فَإِنَّ اللَّهَ أَعَدَّ لِلْمُحْسِنَاتِ مِنْكُنَّ أَجْرًا عَظِيمًا}.
হে নবী! নিজ স্ত্রীদেরকে বল, তোমরা যদি পার্থিব জীবন ও তার শোভা চাও, তবে এসো আমি তোমাদেরকে কিছু উপহার সামগ্রী দিয়ে সৌজন্যের সাথে বিদায় দেই। আর যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আখেরাতের নিবাস কামনা কর, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীলা, তাদের জন্য মহা প্রতিদান প্রস্তুত করে রেখেছেন।-সূরা আহযাব (৩৩) : ২৮-২৯
এই আয়াত দু’টিকে আয়াতে তাখয়ীর বলা হয়। নবীপত্নীদেরকে জানিয়ে দেওয়া হয়, তোমরা দুনিয়ার ভোগবিলাসকে বেছে নাও অথবা নবীর মতো কষ্টসহিষ্ণু জীবন বেছে নাও। যেহেতু তাঁরা সকলেই সর্বোত্তম নবীর জীবনসঙ্গী, স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা নবীর সাথে কষ্টসহিষ্ণু জীবনকে বেছে নিবেন। নবিজিকে ছেড়ে দুনিয়ার মরীচিকার পেছনে তাঁরা ছুটে চলবেন না, তা তো বলাই বাহুল্য। ফলে তাঁরা দুনিয়ার সুখকে পেছনে ফেলে তাঁদের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, তাঁদের প্রাণাধিক প্রিয় স্বামী নবিজির সাথে থাকাকেই বেছে নিলেন। প্রাচুর্যের কিছুটা ছোঁয়া লাগার কারণে যদিও তাঁদের মানসিকতায় কিছু পরিবর্তন এসেছিল, পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আয়াত নাজিল হওয়ার সাথে সাথেই তাঁরা সতর্ক হয়ে যান। তাঁদের সবচেয়ে আপন মানুষ নবিজির জন্য দুনিয়ার সুখকে পেছনে ছুঁড়ে মারেন। আল্লাহ তাআলার পরীক্ষায় তাঁরা উত্তীর্ণ হন। এভাবেই নবীপত্নীগণ তাঁদের সব চাহিদাকে নবিজির পদতলে জলাঞ্জলি দেন। নবিজির সান্নিধ্যে থাকার জন্য সর্বোচ্চ দামী বস্তুকেও দূরে ঠেলে দিতে তাঁরা কুণ্ঠাবোধ করতেন না।-সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৪২৭, ৫২৬২
৪. নিজের চেয়ে স্ত্রীর আরামের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ
একবার নবিজি আর আম্মাজান সাফিয়্যা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা একটি বাহনে চড়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। নবিজি তাঁর হাঁটু মোবারক বিছিয়ে দিলেন। আম্মাজান নবিজির হাঁটুর উপর ভর করে বাহনে চড়লেন! ঘটনাক্রমে নবিজি ও আম্মাজান বাহন থেকে পড়ে যান! আবু তালহা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নিকটেই ছিলেন। নবিজিকে পড়ে যেতে দেখে তিনি বলে ওঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মা-বাবা আপনার জন্য কোরবান হোন! আপনি কী ব্যথা পেয়েছেন? নবিজি বললেন, আমার কোনো সমস্যা নেই। ঐ নারীর প্রতি খেয়াল করো! নবিজির নির্দেশে আবু তালহা আম্মাজানের গায়ে কাপড় ছড়িয়ে দেন, যাতে তাঁর পর্দা নষ্ট না হয়!-সহীহ বুখারী, হাদীস ২৮৬৮
আহ, আমাদের প্রাণের নবিজি! নিজের খেয়াল বাদ দিয়ে স্ত্রীর সমস্যাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন! আমরা কী এমন করে নিজের প্রিয়তমাকে প্রাধান্য দেই! নাকি নিজের স্বার্থ আগে দেখি?! মিলিয়ে দেখা দরকার।
৫. স্ত্রীর পরামর্শের মূল্যায়ন
হুদাইবিয়ার ঐতিহাসিক সন্ধি করলেন নবিজি! বাহ্যিকভাবে সন্ধিটি ছিল নিপীড়নমূলক! কিন্তু আল্লাহ তাআলার নির্দেশে নবিজি সন্ধি মেনে নেন! সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর নির্দেশের কথা জানতেন না। যার কারণে নিপীড়নমূলক সন্ধি তারা প্রথমে মেনে নিতে পারেননি! উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সহ অনেক সাহাবী রাগ চেপে রেখেছিলেন। পরবর্তীতে নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্য তাদের কাছে সন্ধি আল্লাহ তাআলার নির্দেশে হওয়ার কথাটি খুলে বলেছিলেন। তারাও খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু শুরুতে মানবীয় দুর্বলতার কারণে অনেকেই মানতে পারেননি। কারণ মানুষ জুলুমকে কখনোই মেনে নেয় না।
সন্ধিপত্র লেখা শেষ হলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবাদেরকে বললেন, তোমরা উঠ এবং কুরবানী কর ও মাথা কামিয়ে ফেল। কিন্তু কেউ উঠলেন না। তাঁরা স্বেচ্ছায় নবিজির নির্দেশ মানেননি, বিষয়টি এমন না। বরং বাইতুল্লাহ যিয়ারতের জন্য এসেও যিয়ারত না করে ফিরে যাবেন তাদের মন এটা মানছিল না! তারা অপেক্ষায় ছিলেন হয়তো বা নবিজি নিজের মত বদলাবেন আর না হয় আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহী আসবে। এই অপেক্ষায় তারা নির্দেশ পালনে বিলম্ব করিলে। কিন্তু তাদের কাউকে উঠতে না দেখে রাসূলুল্লাহ কষ্ট পেয়ে যান। তিনি (ﷺ) উম্মে সালামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর কাছে এসে লোকদের এ আচরণের কথা বলেন। উম্মে সালামা বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি যদি তাই চান, তাহলে আপনি বাইরে যান ও তাদের সাথে কোন কথা না বলে আপনার উট আপনি কুরবানী করুন এবং ক্ষুরকার ডেকে মাথা মুড়িয়ে নিন। সেই অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বেরিয়ে গেলেন এবং কারো সাথে কোন কথা না বলে নিজের পশু কুরবানী দিলেন এবং ক্ষুরকার ডেকে মাথা মুড়িয়ে নিলেন। তা দেখে সাহাবীগণ উঠে দাঁড়ালেন ও নিজ নিজ পশু কুরবানী দিলেন এবং একে অপরের মাথা কামিয়ে দিলেন।-দ্রষ্টব্য, সহীহ বুখারী, হাদীস ২৫৪৭
আমরা নিজেদের আত্মম্ভরিতার কারণে স্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করি না! নিজেকে সর্বেসর্বা মনে করি! আমা একার নির্দেশ চলবে, আর কারো কোনো কথা শোনা হবে না, এমনই তো আমাদের মানসিকতা! অথচ দুজাহানের সর্দার মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের স্ত্রীর পরামর্শকে মূল্যায়ন করেছেন। তার পরামর্শ গ্রহণ করে মাথা মুণ্ডিয়ে উট নহর করেছেন। নবিজি নিজে যখন আমল করে নিলেন, সাহাবায়ে কেরাম তখন আর বিলম্ব করলেন না। তারাও নবিজির মতো মাথা মুণ্ডন করে উট নহর করে ফেললেন। নবিজি যদি নির্দেশ না মানার কারণে তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে নালিশ দিয়ে দিতেন, তবে তাদের কপালে কী দুর্দশা জুটতো, তা তো বলাই বাহুল্য! নবিজির স্ত্রীর পরামর্শ মেনে নেওয়ার বদৌলতে আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কেরামকেও বড় একটি বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন।
নবিজির দাম্পত্য জীবন নিয়ে আপাতত এতটুকু লেখা হলো। তাঁর মোবারক দাম্পত্য জীবন নিয়ে বহু ঘটনা হাদীস ও সিরাতের কিতাবাদীতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। আমরা এখানে তাঁর দাম্পত্য জীবন নিয়ে খুব সংক্ষেপে কিছু কথা তুলে ধরলাম। এতেও আমাদের জন্য রয়েছে অনেক শিক্ষা।
নবিজির দাম্পত্য জীবন অনুসরণ যে করবে, তার সংসার সুখের হবে, তা তো বলাই বাহুল্য। স্বামী এবং স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্ক কীভাবে অটুট ও মজবুত করা যায়, এর সামগ্রিক রসদ নবিজির সংসারজীবনে বিদ্যমান। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে নবিজির পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক, মাওলানা আবু রুফাইদা ইমরান
লেখক, গবেষক ও শিক্ষক
উস্তায, জামিয়া মাদানিয়া কাওমিয়া শেখ এম এ জব্বার কমপ্লেক্স, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, সিলেট, বাংলাদেশ।